অপরাধঅর্থ ও বাণিজ্যএক্সক্লুসিভবাংলাদেশ

পনেরো দিনে অন্তত হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ভোজ্য তেলের সিন্ডিকেট

বেশ কিছুদিন ধরেই ভোজ্য তেল নিয়ে চলছে তেলেসমাতি। বাড়তি দাম। তেল নেই। বোতলজাত তেলের চাইতে খোলা তেলের দাম বেশি। এমন নানা অভিযোগ সাধারণ ক্রেতাদের। বাড়তি দামের সঙ্গে সরকার আরোপিত ভ্যাটও বেড়েছে সমানভাবে। অভিযোগ উঠেছে বাজার অস্থির করে গত পনেরো দিনে অন্তত হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ভোজ্য তেলের সিন্ডিকেট। এমন অবস্থায় বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে তেলের ওপর থেকে ২০ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্ব বাজারে বাড়তি দামের ভোজ্য তেল ও চিনি বাংলাদেশে আমদানি না করেই অসাধু ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে চলমান মূল্য ধরে দেশের বাজারে পণ্য বিক্রি করেছে। অথচ এসব পণ্য আগেই কম দামে আমদানি করা। মাঝে সাধারণ ক্রেতাদের পকেট থেকে ১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিলো সিন্ডিকেট।

তাই তাদের প্রশ্ন, সরকার এখন যে ভ্যাট প্রত্যাহার করছে তার কি সুফল ক্রেতা সাধারণ পাবেন?এদিকে বুধবার ভোজ্য তেল মিল মালিক এবং ডিলারদের নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠক থেকে বলা হয়েছে, তেলের দাম বৃদ্ধি এবং সরবরাহের সংকট সৃষ্টির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

একইভাবে চিনি ও ছোলার ওপর থেকেও মূসক প্রত্যাহার করা হয়েছে। রমজানকে সামনে রেখে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সরকার ভ্যাট প্রত্যাহার করলে এর সুবিধা কতটা পাবেন সাধারণ ক্রেতারা। ভ্যাট প্রত্যাহার করা এই তিন পণ্য ছাড়াও অন্যান্য নিত্যপণ্যের দামও চড়া। এতে নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের। বলা হচ্ছে, বাজার মনিটরিং জোরদার এবং সঠিক পরিকল্পনা নেয়া হলে বাজার পরিস্থিতি আরও নিয়ন্ত্রণ করা যেতো।

বৃহস্পতিবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-এর (টিসিবি) জন্য ৪টি পণ্য ক্রয়ের প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়। বৈঠকে ১৪ হাজার টন চিনি, ১০ হাজার টন ছোলা, ১৯ হাজার ৫০০ টন মসুর ডাল এবং ১ কোটি ৭১ লাখ ১৫ হাজার ৬৫২ লিটার সয়াবিন তেল কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়।

এই ৪টি পণ্যের ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, টিসিবি আমাদের অর্থনীতির একটি (ব্যাকবোন) মেরুদণ্ড। পণ্যের উৎপাদন যেমন দরকার, তেমনিভাবে সময়মতো ভোক্তাদের কাছে পণ্য পৌঁছে দিতে হয়।

করোনাভাইরাস মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতি দেখা দেয়। সমপ্রতি দেশের বাজারেও কয়েকগুণ বেড়ে যায় নিত্যপণ্যের দাম। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোজ্য তেলের উপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করতে চিঠি দিয়েছিল এনবিআরকে। নিত্যপণ্যটির ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার নিয়ে সার্কুলার জারি যেকোনো সময় হবে বলে জানিয়েছেন এনবিআর’র একজন সদস্য।

মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ২১১ কোটি ৫৭ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ১৯ হাজার ৫০০ টন মসুর ডাল কেনারও অনুমোদন দেয়া হয়। এতে প্রতিকেজি’র দাম পড়ছে ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। প্রতিলিটার ১৬৮ টাকা দরে সেনা ভোজ্য তেল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, সুপার অয়েল রিফাইনড লিমিটেড, মেঘনা ভোজ্য তেল শোধনাগার লিমিটেড, সিটি এডিবল অয়েল লিমিটেড, বসুন্ধরা মাল্টি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড ও শুন শিং এডিবল অয়েল লিমিটেডের কাছ থেকে মোট ১ কোটি ৭১ লাখ ১৫ হাজার ৬৫২ লিটার সয়াবিন তেল কেনার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এতে মোট খরচ হচ্ছে ২৮৭ কোটি ৫৪ লাখ ২৯ হাজার ৫৩৬ টাকা।

অর্থমন্ত্রণালয় থেকে জানান হয়, সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট মওকুফ করা হয়েছে। আগামী ৩০শে জুন পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে। বর্তমান বাজারে সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৬৮ টাকা। ঘোষিত হারে ভ্যাট প্রত্যাহার করা হলে প্রতি লিটারে দাম ৩০ টাকার মতো কমতে পারে বলে ধারণা দিয়েছেন সয়াবিন তেল আমদানিকারকরা।

অর্থমন্ত্রী বলেন, এবার যে উদ্যোগটা নেয়া হচ্ছে, সেটা হলো টিসিবি’কে শক্তিশালী করা। বাজারে সিন্ডিকেটের কাছে যদি কোনো মালামাল থেকে থাকে, দাম বাড়ানোর চেষ্টা করে তারা সেই সুযোগ পাবে না টিসিবি’র মাধ্যমে বাজারে সঠিকভাবে বিতরণ করা গেলে। সেজন্য টিসিবি’র রোলটা এখন গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, প্রতিটি ইউনিয়নে আমরা টিসিবি’কে নিয়ে যাবো। এবার রোজায় এক কোটি পরিবারের কাছে টিসিবি’র পণ্য পৌঁছে দিতে চাই।

একজন আমদানিকারক জানান, ভোজ্য তেলে বর্তমানে তেল আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ, উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং বিক্রয় পর্যায় ৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। চিনিতে সর্বমোট ৬৫ শতাংশ ভ্যাট বা শুল্ক রয়েছে। এরমধ্যে স্পেসেফিক ডিউটি প্রতি টনে ৩ হাজার টাকা।

রেগুলেটরি ডিউটি ২০ শতাংশ, যা কয়েক মাস আগেও ৩০ শতাংশ ছিল। এআইটি বা এডভান্সড ইনকাম ট্যাক্স রয়েছে ২ শতাংশ। আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। এদিকে রমজানকে সামনে রেখে চিনির দাম স্থিতিশীল রাখতে নিয়ন্ত্রণমূলক আমদানি শুল্কে ১০ শতাংশ ছাড় অব্যাহত রাখার ঘোষণা এসেছিল গত ৬ই ফেব্রুয়ারি।

গত বুধবার ভোজ্য তেল মিল মালিক এবং ডিলারদের নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকের পর জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলেছে, বাংলাদেশে সয়াবিন তেলের বাড়তি দাম নিয়ে গত ১৫ দিনে আনুমানিক প্রায় ১০০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।

তেলের দাম বৃদ্ধি এবং সরবরাহের সংকট সৃষ্টির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করা হবে বলে জানিয়েছে অধিদপ্তর।বৈঠক সূত্র জানায়, খুচরা এবং পাইকারি বাজারে তেলের বেশি দাম নেয়া হয়। বাজারে তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে।বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামানের নেতৃত্বে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

২০১০ সালের ৯ই মার্চ রাজধানীর বাজারে এক কেজি মোটা চাল ২৬ টাকা, ডাল ৭৫ টাকা, খোলা আটা ২১ টাকা ও চিনি ৪৮ টাকা; এক লিটার খোলা পাম তেল ৬৫ টাকা ও ডিমের ডজন ৭২ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এটি টিসিবি’র হিসাব। ওই সময়ে রাজধানীর একজন চাকরিজীবীর তিনজনের সংসার চালাতে মাসে ৩০ কেজি চাল, ৩ কেজি ডাল, ২ লিটার তেল, ৩ কেজি আটা, ১ কেজি চিনি, ২ কেজি পিয়াজ ও আড়াই ডজন ডিম কিনতে খরচ করতে হতো ১৪৬২ টাকা। এখন ওই ৭টি নিত্যপণ্য কিনতে এখন খরচ হয় ২৪৭৩ টাকা। অর্থাৎ এক যুগে খরচ বেড়েছে ৭০ শতাংশের বেশি। এ সময়ে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৭৭ শতাংশ।

আরও দেখুন
Back to top button
‘Pushpa 2’ is coming to Bangladesh in Hindi ইব্রাহিম রাইসি যেভাবে ৫০০০ মানুষকে হত্যা করেছিলো Bangladeshi mountaineer Babar Ali climbs Mount Everest