বাড়ি বাংলাদেশ নির্বাচন নির্বাচনের আগে ইউএনও ও ওসিদের বদলি করে কী লাভ

নির্বাচনের আগে ইউএনও ও ওসিদের বদলি করে কী লাভ

1
নির্বাচনের আগে ইউএনও ও ওসিদের বদলি করে কী লাভ

দেশের সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং সব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) বদলি করেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। তাদের কথায়, যদি নির্বাচনকালীন সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন চায় তাহলেই কেবল সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব।

আর ‘একপাক্ষিক নির্বাচনে’ এই বদলি লোক দেখানো বলেও তারা মনে করেন। তাদের কথায়, রাঘব বোয়াল হলেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং জেলা পুলিশ সুপররা (এসপি)। তারাই মাঠের পুলিশ ও প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা তো থাকছেন। তাই শেষ সময়ে ইউএনও আর ওসিদের বদলি করা সরকারি অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।

দেশে মোট উপজেলা ৪৯৫টি। থানা আছে ৬৫২টি। নির্বাচন কমিশন ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে সব উপজেলার ইউএনও এবং সব থানার ওসিকে বদলির সিদ্ধান্ত নেন। নির্বাচনে ইউএনওরা রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। আর ওসিরা আইন-শৃঙ্খলার মূল দায়িত্বে থাকেন।

নির্বাচন কমিশন যা বলছে

বদলির ব্যাপারে কমিশন থেকে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়ার খবর জানা যায় শুক্রবার। শনিবার নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ‘এই বদলি প্রক্রিয়া ডিসেম্বরের ১০ তারিখের মধ্যে শেষ করতে হবে। কারণ নতুন কর্মস্থলে গিয়ে তাদের তো নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের কাছে সব ইউএনও এবং ওসির তালিকা এই মাসের পাঁচ তারিখের মধ্যে পাঠাতে হবে। আমরা যাচাই-বাছাই করে তারপর বদলির জন্য তাদের কাছে আবার তালিকা পাঠাবো। সবাইকেই যারা কোনো স্টেশনে ছয় মাসের বেশি আছেন তাদের বদলি করা হবে। তাদেরকে এক উপজেলা থেকে আরেক উপজেলা এবং এক থানা থেকে আরেক থানায় বদলি করা হবে। কাকে কোথায় বদলি করতে হবে সেটা কমিশনও নির্দিষ্ট করে দিতে পারে। যাদের ব্যাপারে নির্দিষ্ট করা হবেনা তাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তাদের পছন্দ মতো বদলি করতে পারবে।’

কেন এবং কিসের ভিত্তিতে এই বদলির সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনাররা ১০ দিন ধরে বিভিন্ন জেলায় সফর করেছেন। সফরে তারা নানা তথ্য সংগ্রহ করেছেন, বিভিন্ন মহলের সঙ্গে কথা বলেছেন। এরপর তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এই বদলির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’

ডিসি ও এসপিসহ প্রশাসনের আরও শীর্ষ পর্যায়ে বদলি বা রদবদলের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে কমিশন এখনো কোনো নিদ্ধান্ত নেয়নি। তারা প্রতিদিনই বসছেন। নানা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। উচ্চ পর্যায়ে রদবদলের কোনো সিদ্ধান্ত তারা নিলে আমরা তা বাস্তবায়ন করব।’

এই বদলি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কতটা কাজে আসবে

সাবেক সিনিয়র সচিব আবুল আলম শহীদ খান মনে করেন, এই বদলি বা রদবদলে কোনো গুণগত পরিবর্তন আসবেনা। তার কথা, এই ইউএনও এবং ওসিদের বদলি করে কী হবে? প্রাকটিক্যালি তাদের বদলি করে তো নির্বাচন সুষ্ঠু নিরপেক্ষ করা সম্ভব না। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন তো হচ্ছেই না। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের সঙ্গে যারা আছেন তারা তো নির্বাচনে নাই। আছে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থী এবং অন্য নাম-গোত্রহীন কিছু দল। ফলে নির্বাচন যেরকম হওয়ার হওয়ার সেরকমই হবে। মাঝখান থেকে সরকারের অর্থের অপচয় হবে। এক একটা বদলির পেছনে সরকারের এক-দেড় লাখ টাকা খরচ হবে।

তার মতে, নির্বাচন তখনই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় যখন নির্বাচনকালীন সরকার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। কারণ এখানে পুলিশ বা প্রশাসন সরকারের ইচ্ছায় চলে। এই পুলিশ ও প্রশাসনকে আমরা অতীতে ভালো নির্বাচন করতে দেখেছি যখন নির্বাচনকালীন সরকার ভালো নির্বাচন চেয়েছে। তাই নির্বাচনকালীন সরকার চাইলে প্রশাসনে রাম, শ্যাম, যদু, মধু যেই থাকুক নির্বাচন সুষ্ঠু হয়। আর না চাইলে সুষ্ঠু হয় না।

তিনি বলেন, ‘অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই রদবদল করেছে আগেভাগেই। তারা ৩০-৪০ ভাগ রদ বদল করেছে। তারা আগেই হোমওয়ার্ক করে রাখতেন বা দায়িত্ব নেওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিতেন। কিন্তু এবার তফসিল ঘোষণার পর করা হলো। তফসিলের পরেও আগে নির্বাচন কমিশন বলেছে তারা বদলি করবেনা। পরে আবার বলল অভিযোগ পেলে দেখবে। আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশন কাউকে বদলি করতে চাইলে তারা যদি যৌক্তিক মনে করেন তাহলে ব্যবস্থা নেবেন।

এখন আবার হঠাৎ করে গতকাল (শুক্রবার) ঢালাও বদলির কথা বলল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যোগে এত বদলি তো আর হয় নাই। অনেকই মনে করছেন কী আবার হলো যে একযোগে বদলি শুরু হলো।

আর সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘রাঘব বোয়াল তো হলো ডিসি আর এসপিরা। তারাই রিটার্নিং অফিসার ও ওসিদের নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে ডিসি এসপিদের রেখে ইউএনও এবং ওসিদের বদলি করে কী হবে? এগুলো লোক দেখানো। সমালোচনার মুখে পড়েছে তাই বদলি করে দেখাচ্ছে। তারা যে কিছু করার চেষ্টা করছে তা দেখানোর চেষ্টা করছে। আর এসব করে কী হবে? নির্বাচন তো করছে আমরা আর মামুরা। এই নির্বাচন আর উত্তর কোরিয়ার নির্বাচনের মধ্যে তফাৎ কী? সেখানেও তো এক দলীয় নির্বাচনে ৯৯ ভাগ ভোট পড়ে।’

তার কথায়, যদি নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ না হয়, পুলিশ ও সর্বোচ্চ প্রশাসন নিরপেক্ষ না হয় তাহলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। সেটা না করে এই বদলি করে কী হবে। ১৫ বছর ধরেই তো সবখানে দলীয়করণ করা হয়েছে। তারা বদলি হয়ে যেখানে যাবে সেখানে একই কাজ করবে। নির্বাচন যেমন হওয়ার তেমন হবে।

  • জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন হারুন উর রশীদ স্বপন। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।