বাড়ি বাংলাদেশ উন্নয়ন বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১৪৫০০ টাকার পাইপ কাটার কেনা হয়েছে ৯৩ লাখে

বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১৪৫০০ টাকার পাইপ কাটার কেনা হয়েছে ৯৩ লাখে

15

কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, ১৯ ধরনের হ্যান্ড টুলস আমদানিতে ৫ থেকে ১৮ হাজার ৫৪৫ গুণ বেশি দাম দেখিয়েছে সিপিজিসিবিএল

গত ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৩৪৪ দশমিক ৫ কেজি ওজনের একটি ছোট চালান আমদানি করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল)। কক্সবাজারের মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আনা এ চালানটির আমদানি মূল্য দেখানো হয় ২ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা বা ২ লাখ ৫০ হাজার ৮৬৩ মার্কিন ডলার।

আমদানির দুই দিন পর ১১ জানুয়ারি কায়িক পরীক্ষায় দেখা যায়, জার্মানির তৈরি দুটি পাইপ কাটারের দাম ৯২ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। একইভাবে একই জার্মান কোম্পানির দুটি হাতুড়ির দাম দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার টাকা।

এই ধরনের অস্বাভাবিক দাম দেখে বিভ্রান্ত হয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ চালানটি আটকে দিয়ে সিপিজিসিবিএল ও পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের কাছে ব্যাখ্যা চায়। গত ৪ ফেব্রুয়ারি ইস্যুকৃত এরকম দুটি চিঠি পত্রিকার হাতে এসেছে।

গত ২৭ মার্চ প্রতিবেদক দাম পরীক্ষার জন্য জার্মান কোম্পানি কেএস টুলসের ওয়েবসাইট পরিদর্শন করে। ওয়েবসাইটটি দেখায়, একই মানের একটি পাইপ কাটারের দাম ৬০ দশমিক ২৭ ইউরো বা প্রায় ৭ হাজার ২৩২ টাকা। সে হিসাবে আমদানি মূল্য ৬৪২ গুণ বা ৬৪২০০ শতাংশ বেশি দেখানো হয়েছে।

কোম্পানিটির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, আমদানি করা একটি হাতুড়ির দাম ১৩ দশমিক ৯ ইউরো বা ১ হাজার ৬৬৮ টাকা। আমদানি মূল্যে যার দাম ৫৫ গুণ বা ৫৫০০ শতাংশ বেশি দেখানো হয়েছে।

মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কেনা দুটি হাতুড়ির দাম দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার টাকা। ছবি: সংগৃহীত

কাস্টমস সূত্র জানায়, শুধু এই দুটি পণ্য নয়, এই চালানের ১৯টি পণ্যই অযৌক্তিক উচ্চমূল্যে আমদানি করা হয়েছে।

এনবিআরের নথিতে এসব পণ্যের আমদানি ব্যয় এনবিআরের সার্ভারের (আমদানি-রপ্তানি ডেটাবেস) রেকর্ড মূল্যের চেয়ে ৫ থেকে ১৮ হাজার ৫৪৫ গুণ বেশি দেখানো হয়েছে।

এই ডেটাবেসটি মূলত আমদানি রপ্তানি মূল্যসহ বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কিত তথ্যের একটি সংরক্ষণাগার।

চালানটিতে থাকা অন্যান্য টুলসের মধ্যে রয়েছে সেট মেকানিক্যাল প্লায়ার, মাঙ্কি প্লায়ার, টুলবক্স, চিসেল অ্যান্ড স্পান্সার, স্প্যানার এবং কার ফিটার সেট। এসব পণ্য সরবরাহ করে জাপানের সুমিটোমো করপোরেশনের পক্ষ থেকে কেএস টুলস ওয়ার্কজেউজ।

কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কায়িক পরীক্ষার প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাইপ কাটার টুলের দাম ডেটাবেস মূল্যের চেয়ে ১৮ হাজার ৫৪৫ গুণ, পাইপ রেঞ্চ ১ হাজার ৫৩ গুণ, মাঙ্কি প্লায়ারের দাম ৯১২ গুণ, স্ক্রু ড্রাইভারের দাম ৮৩৩ গুণ এবং হাতুড়ির দাম ১১২ গুণ বেশি।

চালানটিতে থাকা ১৯ ধরনের পণ্যের নমুনা, ছবি ও ক্যাটালগ দেখে জানা যায়, অন্যান্য আমদানিকারকরা গত ৯০ দিনে (২০২৩ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ১৫ জানুয়ারি) এসব পণ্যের অন্তত শতাধিক চালান খালাস করেছেন চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে।

আমদানি নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ চালানে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়েছে তা পাওয়ার প্ল্যান্টে সরাসরি ব্যবহার করা পণ্য নয়। এসব হ্যান্ড টুলস অবাধে আমদানিযোগ্য ও সব ধরনের নির্মাণ ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ব্যবহার হয়।

একই ধরনের পণ্য আমদানি তথ্যের সঙ্গে তুলনা করলে সিপিজিসিবিএলের আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক। চট্টগ্রাম কাস্টমসের আমদানির ডেটাবেইজ অনুসারে, গড় শুল্কায়ন মূল্যের তুলনায় এসব পণ্যের আমদানি ব্যয় অন্তত ৫ গুণ থেকে ১৮ হাজার ৫৪৫ গুণ বেশি।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগাযোগ করা হলে মাতারবাড়ী পাওয়ার প্ল্যান্টের প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, কাস্টমস অস্বাভাবিক দাম বললেও স্বাভাবিক দামই ধরা হয়েছে। বিশেষভাবে অর্ডার দিয়ে বানানোর কারণে দাম বেশি মনে হতে পারে।

একটি পাইপ কাটার যন্ত্রের দাম ৪৬ লাখ ৫ হাজার টাকা কীভাবে হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুটি পাইপ কাটার বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য “বিশেষ ধাতু” ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। সুতরাং, দাম বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক।’

পত্রিকা যখন পাইপ কাটার সরঞ্জামটির জন্য প্রস্তুতকারকের কাছে দেওয়া ‘বিশেষ আদেশ’র অনুলিপি চায়, তখন তিনি তা দিতে পারেননি।

আবুল কালাম আজাদ প্রকল্প পরিচালকের পাশাপাশি সিপিজিসিবিএলের একজন পরিচালকও।

এনবিআর ও কাস্টমস কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, সিপিজিসিবিএল তাদের এমন কোনো বিশেষ আদেশ দেখাতে পারেনি যা দেখে মনে হবে এগুলো বিশেষভাবে তৈরি হয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফয়জুর রহমান বলেন, সম্প্রতি পিডিবি এবং সিপিজিসিবিএলের কাছ থেকে আটক চালান সম্পর্কে জবাব পেয়েছি। চিঠিতে কর্তৃপক্ষ উল্লেখ করেছে, আমদানিকৃত পণ্যের দাম বিক্রেতার সঙ্গে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

‘তারা আরও উল্লেখ করেছে যে বাল্ক আমদানির কারণে কিছু পণ্যের দামের তারতম্য থাকা সাধারণ ব্যাপার। যদি অতিরিক্ত দামের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবং মন্ত্রণালয়ের কোনো আপত্তি না থাকে, তাহলে আমাদের কিছুই করার নেই।’

অতীতেও এ ধরণের ঘটনা ঘটেছে বলে কাস্টমসের একাধিক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। এনবিআর সার্ভারেও এরকম কিছু তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এনবিআরের নথি অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বরে মাতারবাড়ী প্রকল্পের জন্য একটি চালান খালাস করে রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠানটি। ইথারনেট সুইচ বা নেটওয়ার্ক সুইচ নামেও পরিচিত এ পণ্যটি জার্মান ব্র্যান্ড হিরশম্যানের। কোম্পানির ওয়েবসাইটে ইথারনেট সুইচের দাম ছিল ৪৮৮১ দশমিক ৮৩ ডলার। যদিও পণ্য চালানটি আমদানি করা হয়েছিল ২ লাখ ৫ হাজার ২১৮ ডলার বা ২ কোটি ৩ লাখ টাকায়। যা আমদানি মূল্যের তুলনায় ৪২ গুণ বা ৪২০০ শতাংশ বেশি।

কাস্টমস কেন চালানটি ক্লিয়ার করেছে জানতে চাইলে কাস্টমসের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা পিডিবি, সিপিজিসিবিএল এবং প্রকল্প পরিচালককে ব্যাখ্যার জন্য চিঠি দিয়েছি। উভয় কর্তৃপক্ষই আমাদের লিখিতভাবে জানিয়েছিল যে পণ্যগুলো বিশেষভাবে প্রকল্পের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।’

তিনি বলেন, ‘এসব সুইচের ব্যবহারকারীর ম্যানুয়াল, ক্যাটালগ এবং সুইচগুলো সম্পর্কে অন্যান্য তথ্য দেখে তা বিশেষভাবে নির্মিত বলে মনে হয় না। একই ব্যান্ডের অন্য আমদানিকারকদের আমদানি করা পণ্যের সঙ্গেও আমরা যাচাই করেছি।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘যদি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ (সিপিজিসিবিএল এবং পিডিবি) অতিরিক্ত ব্যয়কে ঠিক বলে, তাহলে আমাদের কিছু করার নেই।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সর্বশেষ চালান আটকে কাস্টমস কর্মকর্তাদের ভূমিকা প্রশংসনীয়।

তিনি বলেন, ‘বিশেষ আদেশে পাইপ কাটার, হাতুড়ি এবং স্ক্রু ড্রাইভারের মতো হ্যান্ড টুলস সংগ্রহের দাবি হাস্যকর। এটি সম্ভবত বড় আকারের দুর্নীতির উদাহরণ হতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটিকে “পুকুর চুরি” না বলে “সাগর চুরি” বলতে হবে।’

পণ্যের অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়ে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ বিষয়টি অধিকতর তদন্ত করার আহ্বান জানান তিনি।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলমও সরঞ্জামের অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যকে হাস্যকর বলে মন্তব্য করেছেন।

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন শামসুল বলেন, ‘যারা এগুলো থেকে উপকৃত হয় তাদের কাছে এই ধরনের হাস্যকর দামকেও স্বাভাবিক বলে মনে হতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘জ্বালানি খাতে এটি নতুন ঘটনা নয়। সরকারি-বেসরকারি সব বিদ্যুৎ প্রকল্পেই এ ধরনের অস্বাভাবিক দাম দেখানো হচ্ছে। কিন্তু দিনের শেষে, এই অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হয় ভোক্তাকে।’