মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা বিড়ম্বনা,ভোগান্তি চরমে
নেত্রকোনার হাবিবুর রহমানের চোখে মুখে হতাশার ছাপ। তার ১৪ বছর বয়সী ছেলে মো. শরীফ ক্যান্সারে আক্রান্ত। ছেলের গলার এক সমস্যা নিয়ে আড়াই বছর ধরে দৌড়ঝাঁপ করছেন। কয়েক মাস আগে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানিয়েছেন তার ক্যান্সার।
প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সেখানকার চিকিৎসকরা শরীফকে ঢাকার মহাখালী ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে পাঠিয়েছেন রেডিও থেরাপি নেয়ার জন্য। হাবিবুর গত শনিবার সকাল থেকে গতকাল পর্যন্ত হাসপাতালে ঘুরছেন। সঙ্গে তার স্ত্রী রাবেয়া খাতুন ও আরেক ছেলে।
প্রথমদিন হাসপাতালে আসার পরই তাকে বলা হয় মেশিন নষ্ট। হাসপাতালের একটি স্লিপে সিল মেরে দেয়া হয় রেডিও থেরাপি মেশিন স্বল্পতার কারণে রেজিস্ট্রেশনের সম্ভাব্য তারিখ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তারপরই যেন হাবিবুরের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
হাবিবুর রহমান বলেন অনেকেই থেরাপি দিতে না পেরে বেসরকারি হাসপাতালে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু আমি গরিব মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে এত খরচ যোগাতে পারবো না। আড়াই বছরে তার পেছনে চিকিৎসা বাবদ কয়েক লাখ টাকা খরচ করেছি।
ধান বিক্রি ও জমি বন্ধক দিয়ে এতদিন খরচ চালিয়েছি। তার চিকিৎসার জন্য বড় ছেলেটার সৌদি আরবের ভিসাটাও বাতিল হয়েছে। এখন সরকারি হাসপাতাল ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নাই। আর এতদিন ধরে চারজন মানুষ ঢাকায় থাকা-খাওয়া অন্যান্য খরচ যোগাতে গিয়ে আমার পকেট শূন্য হয়ে যাচ্ছে।
হাবিবুর রহমানের মতো হতাশা দেখা দিয়েছে পাবনার সোহেল মিয়ার। ৭০ বছর বয়সী মা আছিয়া খাতুনকে নিয়ে তার যেন ভোগান্তির শেষ নাই। ক্যান্সার আক্রান্ত মাকে বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা করিয়ে শেষ পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
সেখানকার চিকিৎসকরাও প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আছিয়া খাতুনকে রেডিও থেরাপি দেয়ার জন্য মহাখালীর ক্যান্সার গবেষণা হাসপাতালে রেফার্ড করেন। সোহেল মিয়া মাকে নিয়ে ক্যান্সার হাসপাতালে আসেন। এখানে আসার পর ফাইলপত্র দেখে চিকিৎসকরা জানান মেশিন নষ্ট। এখনি থেরাপি দেয়া সম্ভব না।
হাবিবুর রহমান আরও বলেন, ময়মনসিংহের চিকিৎসকরা বলেছিলেন ছেলের বয়স কম। ঢাকায় নিয়ে দ্রুত রেডিও থেরাপি দিলে সুস্থ হয়ে যাবে। তাই তাড়াহুড়ো করে মানুষের কাছ থেকে ঋণ করে টাকা নিয়ে ঢাকায় এসেছি। কিন্তু এখানে আসার পর বলা হচ্ছে মেশিন নষ্ট। কবে ঠিক হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নাই। এত বড় হাসপাতালে মাত্র একটি মেশিন দিয়েই হাজার হাজার রোগীর সেবা দেয়া হচ্ছে।
মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতালে হাবিবুর রহমান ও সোহেল মিয়াই শুধু হতাশা নিয়ে ঘুরছেন না। রেডিও থেরাপি মেশিন নষ্ট হওয়াতে এ রকম শ’ শ’ রোগীর স্বজন পড়েছেন ভোগান্তিতে। প্রিয় মানুষটিকে বাঁচাতে তাদের আকুতি ও চেষ্টার কমতি নাই। কিন্তু মেশিন স্বল্পতা যেন তাদের সব চেষ্টা মিইয়ে দিচ্ছে।
ক্যান্সার রোগীদের জন্য দেশের একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতালটিতে সরজমিন ঘুরে রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র দেখা গেল। রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই হাসপাতালটিতে প্রতিদিন দেশের ৬৪টি জেলা থেকে রোগী আসেন। বেশির ভাগ রোগীই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের। কম খরচে চিকিৎসা নিতে এখানেই আসেন।
আবার বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে খরচ সামলাতে না পেরে এখন অনেকেই এই হাসপাতালে আসেন। কিন্তু তারা যে ধারণা নিয়ে আসেন সেটি হাসপাতালে আসার পর পাল্টে যায়। কারণ বিশেষায়িত হাসপাতালটিতে শুধু রেডিও থেরাপি নয় পদে পদে ভোগান্তি।
এখানে বহির্বিভাগের টিকিট কাটা থেকে শুরু করে রোগী দেখানো, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ভর্তি করানো, শয্যার ব্যবস্থা, কেমো থেরাপির সিরিয়াল দেয়া, হুইল চেয়ার পাওয়াসহ হাসপাতালের বিভিন্ন সেকশনের কর্মচারীদের বকশিস বাণিজ্যে অতিষ্ঠ রোগীর স্বজনরা। হাসপাতালটিতে ১০ টাকার টিকিট কাটার সিরিয়ালও বিক্রি করে একটি সিন্ডিকেট।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের আসমা বলেন, ২০১৪ সাল থেকে আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত। ওই সময় ল্যাবএইড হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা করিয়েছি। ২০১৫ সালে রেডিও থেরাপি নিয়েছি ক্যান্সার হাসপাতাল থেকে। কয়েক বছর কোনো সমস্যা ছিল না। এ বছরের শুরু থেকে সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসকের কথা মতো অস্ত্রোপচার করাই। তারপর গত তিন মাস ধরে রেডিও থেরাপির জন্য হাসপাতালে ঘুরতেছি। কিন্তু হাসপাতাল থেকে থেরাপির কোনো ব্যবস্থা করতে পারছি না। বারবার মেশিন নষ্টের কথা বলা হচ্ছে।
সিরিয়ালের প্রথমে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতে হলে ৫০০ টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়। সিরিয়ালের প্রথমে ডাক্তার দেখাতেও একই অবস্থা। তবে গত কয়েক মাস ধরে রেডিও থেরাপি মেশিন নষ্ট হওয়াতে রোগীদের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। কারণ হাসপাতালের ৬টি মেশিনের ৪টি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এই চারটি মেশিন আর ঠিক করা যাবে না।
আরেকটি মেশিন নষ্ট তবে এটি এখনি ঠিক করা যাবে না। শুধু ১টি মাত্র সচল মেশিন দিয়ে চলছে রেডিও থেরাপি সেবা। ক্যান্সার হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৬টি মেশিনের বয়স ১৫ বছরের মতো। প্রত্যেকটি মেশিন যখন সচল ছিল তখন প্রতিদিন গড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ রোগীর সেবা দেয়া যেতো।
আর এখন একটি মেশিন সচল থাকায় মাত্র ৭০ থেকে ৭৫ জনকে থেরাপি দেয়া যায়। যাদেরকে থেরাপি দেয়া হয় তারিখ ধরে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দিতে হয়। তাদের শেষ না হলে নতুন করে কাউকে থেরাপি কার্ড দেয়া হয় না। এখন প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে ৪ জনকে নতুন করে কার্ড দেয়া হয়। ফলে প্রতিদিনই রোগীর চাপ ও চাহিদা বাড়ছে। যখন সবক’টি মেশিন চালু ছিল তখনই রোগীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে।
ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রনদা প্রসাদ রায় বলেন, মেশিনগুলো দেশে পাওয়া যায় না। কয়েকটি দেশই এই মেশিন তৈরি করে। তাই চাইলেও পাওয়া যায় না। এটি সরবরাহ করার ঠিকাদারও বেশি নাই দেশে। আমদানি করতেও নানা জটিলতা আছে।
আগে যেখানে ৭০০ রোগী থেরাপি নিতে পারতো এখন মাত্র ৭৫ জন। তিনি বলেন, এমনিতেই আমাদের চাহিদার তুলনায় মেশিন স্বল্পতা আছে। পুরো দেশের মানুষের বিপরীতে ১৭০টি মেশিনের দরকার। প্রতি ১০ লাখ মানুষের বিপরীতে ১টি করে মেশিন দরকার। সেখানে যে কয়টি ছিল তার সবক’টি এখন অচল।
ঢাকার বাইরে এবং ক্যান্সার হাসপাতাল মিলিয়ে মোট ৪টি মেশিন চালু। তবুও আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। মেশিন থাকলে রোগীদের সেবা দিতে আমাদের সমস্যা নাই। বাহিরে যে সেবা নিতে ৫০ হাজার টাকা লাগে আমাদের এখানে লাগে ২ হাজার।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে যে মেশিন আছে সেগুলো ভ্যারিয়েন্টের মেশিন ছিল। তারা বিক্রি করে দিয়েছে সিমেন্স কোম্পানির কাছে। সিমেন্স কোম্পানি অক্টোবরের আগে কার্যক্রম শুরু করছে না। আর শুরু করলেও যে আমাদের নষ্ট মেশিন ঠিক হবে তার নিশ্চয়তা নাই। এ ছাড়া প্রতি বছরই আমি এই বিভাগের পক্ষ থেকে মেশিনের চাহিদা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দেই।
ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. এম নিজামুল হক বলেন, গত বছরও আমরা ৬টি মেশিন দিয়ে থেরাপি দিয়েছি। কিন্তু এই বছরের এপ্রিল মাসে ৪টি অফিসিয়ালি পরিত্যক্ত ও আরেকটি নষ্ট হওয়াতে ১টি দিয়েই থেরাপি দিতে হচ্ছে। এতে করে রোগীদের চাপ বাড়ছে।
বাংলা ম্যাগাজিন /এসকে