বাড়ি অর্থ ও বাণিজ্য ব্যাবসায়ী সিন্ডিকেটের উচ্চ মুনাফার টার্গেটে রমজান

ব্যাবসায়ী সিন্ডিকেটের উচ্চ মুনাফার টার্গেটে রমজান

3
ব্যাবসায়ী সিন্ডিকেটের উচ্চ মুনাফার টার্গেটে রমজান

বলা হয়, রমজান মাস সংযমের। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ মাস উপলক্ষ্যে ছাড়ে ছড়াছড়ি থাকলেও— এ দেশে চলছে দাম বাড়ানোর প্রতিযোগতা। দাম বাড়াতে এক হয়েছে অসাধু সিন্ডিকেট চক্র। অধিক লাভের আশায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে তারা। এ চক্রের (সিন্ডিকেট) কাছে কার্যত জিম্মি দেশের সাধারণ মানুষ।

নানা বাহানায় দাম বাড়াতে বাড়াতে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের অবস্থা শোচনীয় করেছে চক্রটি। সেহরি ও ইফতারিতে কোনো কিছু খাওয়াই এখন আকাশকুসুম কল্পনা। রমজানে দাম বাড়বে না বলে— সরকারের দেয়া হাঁকডাক সব উবে গেল। রমজানের আগে সবকিছুতে ফের দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষ বিরক্ত সাধারণ মানুষ। এ সিন্ডিকেট চক্রকে ভর্ৎসনা করে বলছে এই রমজান ‘খোশ আমদেদ বয়ে আসছে সিন্ডিকেটদের’ জন্য। অন্যদিকে যারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াবে— তাদের কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে ধর্মে।

সাধারণ মানুষ বলছেন, প্রতিবছর রমজান এলেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। সরকার বাড়বে না বলে নানা কথা বললেও শেষমেশ দাম বেড়ে যায়। দাম বাড়ানোর ‘প্রধান খেলোয়াড়’ অসাধু ব্যবসায়ীরা। রমজান মাসে তারা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন। রমজান যেন ব্যবসায়ীদের ‘পৌষ’ মাস।
খাদ্য মজুতে ইসলামের বিধান

জানা গেছে, দ্রব্যমূল্য গত আড়াই বছর ধরেই আকাশছোঁয়া। রমজানে সেটা নিয়ে ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষ। অবস্থা এমন, গরিব ও সাধারণ মানুষ না খেয়ে ধুঁকবে আর বড়লোকরা কিনবে দেদার। এটা তো কোনো সভ্য সমাজের কাজ হতে পারে না। বেগুন এবারও ক্রয় ক্ষমতায় বাইরে।

এবার শতক না গেলেও কাছাকাছি চলে এসেছে। প্রতি কেজি লম্বা বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৯০ টাকায়। এছাড়া সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ২০-৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে ব্রয়লার মুরগির দাম। প্রতি কেজির জন্য ২২০-২৪০ টাকা চাইছেন বিক্রেতারা। এ ছাড়া সোনালি মুরগি ৩৫০ টাকা, দেশি মুরগি ৫৮০-৬০০ টাকা, সাদা লেয়ার ২৬০ টাকা ও লাল লেয়ার বিক্রি হচ্ছে ৩৩০ টাকায়। আর জাতভেদে প্রতি কেজি হাঁস বিক্রি হচ্ছে ৫৫০-৯০০ টাকায়।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, মানভেদে প্রতি কেজি বেগুন ৭০-৯০ টাকা, শিম ৪০-৫০ টাকা, আলু ৩৫ টাকা, বরবটি ৮০ টাকা, মুলা ৩০ টাকা, শালগম ২৫-৩০ টাকা, শসা ৬০ টাকা ও লতি ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতি কেজি পেঁপে ৪০ টাকা, ক্ষীরাই ৫০-৬০ টাকা, গাজর ২০-৩০ টাকা, টমেটো ৫০-৬০ টাকা, চিচিঙ্গার ৬০ টাকা, ঝিঙ্গা ৮০ টাকা ও পেঁয়াজের কলি বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়।

আর প্রতি পিস লাউ ৪০-৬০ টাকা, আকারভেদে প্রতিপিস ফুলকপি ও বাঁধাকপি ৩০-৪০ টাকা ও ব্রকলি ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এদিকে গত সপ্তাহে সেঞ্চুরি হাঁকানো করলা ও ঢ্যাঁড়শ বিক্রি হচ্ছে যথাক্রমে ১০০-১৪০ টাকা ও ১২০ টাকা কেজিতে।

ক্রেতারা বলছেন, রোজা এলেই তাদের জিম্মি করে ফেলে ব্যবসায়ীরা। শাকপাতা থেকে শুরু করে সবকিছু খেতে হয় অস্বাভাবিক বাড়তি দামে। আর বিক্রেতারা বলছেন, সবজি বিক্রেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, ক্রেতারা একদিনে সব কিনতে চায়। এতে করে বাজারে নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। আর এটা আগে বুঝতে পেরেই জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয় পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তখন বাজারে এসে কাস্টমাররা বলে দাম বেশি।

তারা আগে-পরে কিনলেই কিন্তু এমন হয় না। রামপুরা বাজারে কথা হয় আকাশ নামে এক ক্রেতার সঙ্গে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, রোজা উপলক্ষ্যে বাইরের বিভিন্ন দেশ, এমনকি মুসলিম সংখ্যালঘু কিছু দেশেও পণ্যের দাম কমে। আর আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়ায়। মনে হয়, সব সংযম আমাদেরই করতে হবে। ব্যবসায়ীরা সংযমের প্রয়োজন বোধ করেন না। সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ ছাড়া এই সিন্ডিকেট বন্ধ করা সম্ভব না। তিনি বলেন, সয়াবিন তেলের দাম ১৬৩ টাকা লিটার নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ এখন বিক্রেতা বলে, তাদের আগের স্টক শেষ হয় নাই।

আবার বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, চিনির দাম এক টাকাও বাড়বে না, পর্যাপ্ত আছে; আর বিক্রেতা বলছে, এক আগুনে চিনিই নাই এখন বাজারে। আমরা সবই বুঝি। বুঝলেও কিছু করতে পারি না। ক্রেতারা বলেছেন, আগের রমজান থেকে এ রমজানে খেজুর, ছোলা, ডাল, চিনিসহ বেশ কিছু পণ্যের দাম অনেকটাই বেড়েছে। যা অনেকটা নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে বলা চলে।

রোজার পণ্যের বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। আর প্রতি কেজি ছোলার ডাল ১০০-১২০ টাকা, ডাবলির ডাল ৮৫ টাকা, মোটা দানার মসুর ডাল ১০৫-১১০ টাকা, চিকন মসুর ডাল ১৩৫-১৪০ টাকা, মোটা দানার মুগ ডাল ১৪৫-১৫০ টাকা, চিকুন মুগ ডাল ১৭০-১৮০ টাকা ও খেসারি ডাল ১০৫-১১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

অন্যান্য পণ্যের মধ্যে বেসন ১৪০-১৬০ টাকা, খোলা আটা ৫৫-৬০ টাকা, প্যাকেট আটা ৬৫-৬৮ টাকা, খোলা ময়দা ৬৫-৭০ টাকা এবং প্যাকেট ময়দা ৭৫-৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৪৫-১৫০ টাকায়। আর প্যাকেটজাত চিনি বলতে গেলে পাওয়াই যাচ্ছে না। যেসব বিক্রেতার কাছে পাওয়া যাচ্ছে, তারা বলছেন আগের স্টক।

বাজার করতে আসা চাকরিজীবী সাইফুজ্জামান বলেন, সরকার বলেছিল— রোজার বাজারে জিনিসপত্রের দাম কম থাকবে। সে রকম কিছু তো দেখছি না। উল্টো বেগুনের দাম বেড়ে গেছে। রোজায় চাহিদা বাড়লেই কী ব্যবসায়ীরা বেশি নেবে, ক্ষোভ নিয়ে বলেন তিনি।

বাজার করতে আসা আরেক ক্রেতা শাহীন রহমান বলেন, যখন যেটা বেশি লাগে তখন সেটারই দাম বেড়ে যায়। অদ্ভুত এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি।

এদিকে বাজারে আসতে শুরু করেছে নতুন দামের ভোজ্যতেল। এরপরও নতুন বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি না করে পুরাতন বোতল ক্রেতাকে ধরিয়ে বাড়তি দাম চাইছেন বিক্রেতারা। বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে খোলা সয়াবিন তেলেও। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল আজ ১৬০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।

রোজার আগে ঊর্ধ্বমুখী মসলার বাজারও। জিরা বাদে বেড়ে গেছে প্রায় সব ধরনের মসলার দাম। প্রতি কেজি জিরা ৭৫০ টাকা, এলাচ ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা, দারুচিনি ৪৬০-৪৭০ টাকা, গোলমরিচ ৯০০ টাকা ও লবঙ্গ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এ মুহূর্তে।

বাড্ডা বাজারের মুদি দোকানি আল আমিন বলেন, দাম তো সবকিছু আগেই বাড়িয়ে রেখেছে। এখন এমন অবস্থা হয়েছে একটু ভালো মন্দ খাওয়ার উপায় নেই। ছুটির দিনে রোজার বাজার করতে এসেছিলাম, অনেক কিছুই টাকায় কুলায়নি। তাই না নিয়ে ফিরে যাচ্ছি।

মালিবাগ বাজারের বিক্রেতা মুক্তার হোসেন বলেন, এবারের রোজা হবে আরও খরুচে। তাতে ভালো-মন্দ খেয়ে রোজা পালনের অপেক্ষায় থাকা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কপালে ভাঁজ পড়ল দুশ্চিন্তার। কিন্তু খুচরা বাজারের বিক্রেতাদের কিছুই করার নেই। আমরা যে দামে কিনে আনি তার থেকে কিছুটা লাভে বিক্রি করি। সরকারের মিলগুলো এবং পাইকারি বাজারে কঠিন মনিটরিং করা দরকার।

যদিও রোজায় পণ্যের দামের লাগাম টানতে সরকার গত ৮ ফেব্রুয়ারি খেজুর, চিনি, সয়াবিন তেল ও চাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়েছিল। তবে সয়াবিন তেল ছাড়া অন্য তিন পণ্যে দাম সামান্যও কমেনি বরং বেড়েছে। সয়াবিন তেলেও সবাই সুফল পাচ্ছে না। কারণ বাজারে ১ মার্চ থেকে নতুন কম দামের সয়াবিন তেল সরবরাহ করার কথা থাকলেও এখনো বেশির ভাগ দোকানে পুরোনো দামের তেল বিক্রি হচ্ছে।

কিছু দোকানে কম দরের পাঁচ লিটারের বোতল আসলেও এক বা দুই লিটারের বোতলের দেখা মিলছে না। ইসমাইল আলি নামের এক ক্রেতা বলেন, গত এক মাসে আগে যে খেজুর কিনেছি ৬৭০ টাকায়, আজ (গতকাল) সেই খেজুর কিনলাম ৮৫০ টাকায়। রোজায় চিনি, খেজুর, সয়াবিন তেল, ছোলাসহ ইফতারসামগ্রী তৈরিতে ব্যবহূত বিভিন্ন পদের ডালের চাহিদা বেড়ে যায়। এ বছর এসব পণ্যের প্রায় সবগুলোর দামই চড়া। এর মধ্যে চিনি ও তেলের দাম এক বছরের বেশি সময় ধরে বাড়তি।

তার সঙ্গে রোজাকে সামনে রেখে এবার খেজুর, ছোলা ও ডালের দামও বেড়ে গেছে। এছাড়া পেঁয়াজ, বেগুন, শসা ও লেবুর দামও চড়া। বিদেশি ফলের দাম নাগালের মধ্যে নেই। তাতে ইফতার আয়োজনে সাধারণ মানুষকে এবার খরচ সামলাতে বেশ হিমশিম খেতে হবে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরের মধ্যে এবারই রোজার বাজারে চিনি, খেজুর, ছোলা, পেঁয়াজ ও অ্যাংকর ডালের দাম সবচেয়ে বেশি। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে রোজার আগে বাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৭৮ থেকে ৮০ টাকা। এ বছর চিনির কেজি ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা। তাতে এক বছরে চিনিতে খরচ বেড়েছে সর্বনিম্ন ৬০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬৭ টাকা। টিসিবির হিসাবে, ২০২১ সালে রোজার আগে বাজারে ছোলার দাম ছিল কেজিপ্রতি ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। এ বছর দাম বেড়ে হয়েছে ১০০ থেকে ১১০ টাকা। তাতে দুই বছরের ব্যবধানে ছোলার দাম বেড়েছে কেজিতে ২৫ থেকে ৪০ টাকা। তবে টিসিবির দামের চেয়ে বাজারে চিনি ও ছোলার দাম আরও বেশি।

বাজারভেদে এ দুটি পণ্যের দাম টিসিবির দেওয়া দামের চেয়ে ৫ টাকার বেশি। টিসিবির তথ্য বলছে, গত দুবছরে বাজারে অ্যাংকর ডালের দাম বেশ বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি কেজি অ্যাংকর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকা। গত বছর এ দাম ছিল ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। আর ২০২২ সালের রমজানের আগে অ্যাংকর ডালের দাম ছিল কেজিপ্রতি ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। বাজারে বর্তমানে দেশি পেঁয়াজের দাম ৯০ থেকে ১০০ টাকা কেজি। গত বছর প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। আর ২০২২ সালে এ দাম ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা।