বাড়ি রাজনীতি বিএনপি ৩ মাসে কারাগারে ১২, রাজপথে ১৮ জন বিএনপির নেতা-কর্মীর মৃত্যু

৩ মাসে কারাগারে ১২, রাজপথে ১৮ জন বিএনপির নেতা-কর্মীর মৃত্যু

1
৩ মাসে কারাগারে ১২ রাজপথে ১৮ জন বিএনপির নেতা কর্মীর মৃত্যু

কারাবন্দী বিএনপি নেতাকর্মীদের মৃত্যুর সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়েইে চলছে। গত বছরের ২৮ অক্টোবর থেকে অদ্যাবধি তিনমাসে কারা হেফাজতে বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের ১২ জন নেতাকর্মী মারা গেছেন বলে বিএনপির দাবি। এছাড়া চলমান আন্দোলনে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হামলায় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের আরও ১৮জন নেতাকর্মী মৃত্যুবরণ করেছেন। কারাগারে দলের নেতাকর্মীদের মৃত্যুর জন্য বিএনপি পুলিশী নির্যাতন এবং কারাকর্তৃপক্ষের অবহেলাকে দায়ী করছে। বিএনপি ও নিহত নেতাকর্মীদের পরিবারের দাবি, চিকিৎসায় অবহেলার কারণেই তাদের স্বজনদের মৃত্যু হয়েছে। অনেক মৃত নেতার পরিবার তাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

বিএনপির দপ্তর সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন পালনে সারাদেশে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের যেসব নেতাকর্মী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। জেলা নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে।

কারাগারে মারা গেছেন ১২ জন নেতা : বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত কারাগারে বিনা চিকিৎসা কিংবা চিকিৎসায় অবহেলার কারণে তাদের ১২ নেতাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৮ জানুয়ারি রাতে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সাত্তার জেলা কারাগারে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। বিএনপির দাবি, মিথ্যা মামলায় দীর্ঘদিন ধরে কারাগারের ভেতরে পুলিশী নির্যাতনে অসুস্থ হলে ওইদিন রাত ৮টা ২০ মিনিটে তিনি মারা যান। এছাড়া গত বছরের ১ নভেম্বর কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার বুড়িচং উপজেলার মোকাম ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি মো. জাকির হোসেনকে গ্রেফতারের সময় পুলিশী নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়। গত ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম মহানগরের চাঁদগাও থানার ৫নং মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সহ-সভাপতি গোলাপুর রহমানকে (গোলাপ কন্টাক্টর) ঢাকার নয়াপল্টনস্থ বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ২৫ নভেম্বর তিনি কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। গত ২৪ নভেম্বর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ৩৯নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুলকে পুলিশ অসুস্থ অবস্থায় গ্রেফতার করে। ৩০ নভেম্বর ফের অসুস্থ হওয়ায় পুলিশ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ শেষে শ্রীপুর রেলস্টেশন থেকে গ্রেফতার করা হয় গাজীপুরের শ্রীপুরের কাওরাইদ ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান খান হিরোকে। ১ ডিসেম্বর কাশিমপুর কারাগারে তার মৃত্যু হয়।

রাজশাহী পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম (৫২) ১১ ডিসেম্বর রাজশাহী কারাগারে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বিএনপির মিডিয়া সেলের ডিজিটাল বিভাগের প্রধান ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য সাংবাদিক মাহবুব মানিককে গত ৩০ অক্টোবর বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে গুরুতর অসুস্থ হলে গত ২০ নভেম্বর তিনি মুক্তি পান। একপর্যায়ে গত ১৫ ডিসেম্বর তিনি মারা গেছেন। নওগাঁর নজিরপুর পৌরসভার ২নং ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মতিবুল মন্ডলকে গত ২৭ নভেম্বর গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে অসুস্থ হয়ে ২০ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

এছাড়া গাজীপুরের কাপাসিয়ার দূর্গাপুর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মো. শফিউদ্দিন মাস্টারকে গত ২৬ অক্টোবর গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে অসুস্থ হয়ে ২৫ ডিসেম্বর মারা যান। মুগদা থানা শ্রমিকদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ফজলুর রহমান কাজলকে গত ২৬ অক্টোবর গ্রেফতারের পর পুলিশী নির্যাতনে তিনি অসুস্থ হন। গত ২৬ ডিসেম্বর কারাগারের ভেতর স্ট্রোক করেন। বিএনপি ও পরিবারের দাবি কাশিমপুর কারাকর্তৃপক্ষের অবহেলা ও বিনা চিকিৎসায় ওইদিন তিনি কারাগারেই ইন্তেকাল করেন। খুলনা মহানগর মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম দলের সহ-সাধারণ সম্পাদক মো. কামাল হোসেন মিজান র্দীঘদিন কারাগারে থাকাবস্থায় চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি সকালে বাগেরহাট জেলা কারাগারে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার দোহার উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সভাপতি মো. হারুন মেম্বারকে গত ২০ নভেম্বর গ্রেফতার করে পুলিশ। অসুস্থ অবস্থায় ২৪ ডিসেম্বর জামিনে মুক্ত হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৫ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।

আন্দোলনে মারা গেছেন ১৮ জন : বিএনপির চলমান আন্দোলন কর্মসূচি পালনকালে দলটির আরও ১৮ জন নেতাকর্মী পুলিশের গুলি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হামলা ও হয়রানিতে মারা গেছেন। গতবছরের ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের দিন পুলিশের গুলি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ঢাকা মহানগরীর যুবদল নেতা শামীম। ২৯ অক্টোবর বিএনপির হরতাল শেষে বাড়ি ফেরার পথে আদাবর থানার সাবেক যুবদল নেতা মো. আবদুর রশিদকে একটি নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়। একইদিনে ফরিদপুরের নগরকান্দা ইউনিয়ন বিএনপির এক নেতার বাড়িতে পুলিশ তল্লাশী ও ভাঙচুর চালানোর সময় ওই নেতার স্ত্রী রেঞ্জুয়ারা বেগম ভয় পেয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিনের সদস্য ও সচিত্র স্বদেশের সাবেক নির্বাহী সম্পাদক সাংবাদিক রফিক ভুঁইয়া ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশে দায়িত্ব পালনকালে টিয়ারশেলের আঘাতে আহত হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৯ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ৩১ অক্টোবর বিএনপির অবরোধ চলাকালে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার ছয়সূতি ইউনিয়ন ছাত্রদল নেতা রেফায়েত উল্লাহ ও ইউনিয়ন কৃষকদলের সভাপতি মো. বিল্লাল মিয়া পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। ১ নভেম্বর সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লালবাজারে বিএনপির অবরোধ চলাকালে পুলিশের গাড়ি চাপায় গোলাপগঞ্জ উপজেলা যুবদলের সদস্য দিলু আহমদ জিল্লু মারা যান।

কিশোরগঞ্জের ভৈরব পৌর শাখার ৭নং ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য মো. আশিক মিয়া ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের দিন পুলিশের টিয়ারশেলে আহত হয়ে ভাগলপুর জহিরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩১ অক্টোবর রাতে মৃত্যুবরণ করেন। মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য বিপ্লব হাসান বিপুল গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশে পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেলের আঘাতে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ৩ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সুলতান মাহমুদ চৌধুরীর বাসায় গত ৫ নভেম্বর পুলিশ ও র‌্যাব তল্লাশি চালায়। এসময় গ্রামবাসী ও বিএনপি নেতাকর্মীরা বাঁধা দিলে পুলিশ ও র‌্যাবের গুলিতে ৩ জন গুলিবিদ্ধ হন। তন্মধ্যে জালিয়া পালং ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক জাগির হোসেন কক্সবাজার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ নভেম্বর মারা যান। মাগুরার মোহাম্মদপুর উপজেলার নহাটা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য মো. রিয়াজকে ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা পিটিয়ে হত্যা করেছে। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. স্বপন ১১ নভেম্বর ডিবি পুলিশের তাড়া খেয়ে পুকুরে ঝাঁপ দিলে পুকুরের ভেতরে বিদ্যুস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ১৮ নভেম্বর রাতে শান্তাহার থেকে মোটরসাইলযোগে যাওয়ার সময় নওগাঁ পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি কামাল আহমেদকে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা কূপিয়ে হত্যা করেছে।

এছাড়াও বগুড়ার শেরপুরের বিশালপুর ইউনিয়ন বিএনপির সদস্য আব্দুল মতিন মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে গত ২২ নভেম্বর রাতে নিকটাত্মীয়ে বাড়িতে থাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলে রাত ৮টার সময় মান্দাইল গ্রামের স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা তাকে পিটিয়ে হত্যা করে পাশের ধান ক্ষেতে লাশ ফেলে যায়। বগুড়ার শাহজাহানপুরের খোট্টাপাড়া ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি ফোরকান আলী র‌্যাব-পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পালানোর সময় পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হলে হার্ট এটাকে মারা যান। খুলনার পাইকগাছা উপজেলা যুবদল নেতা শহিদুর রহমান শহীদকে গ্রেফতারের খবর শুনে তার বৃদ্ধ পিতা মো. ইউনুচ আলী গাজী (৭০) গত ২০ ডিসেম্বর রাতে স্ট্রোক করে মারা গেছেন। চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের সহ-সভাপতি ইসমাইল হোসেনের বড় ভাই ও সীতাকুন্ডু ২ নং বারৈয়াঢালা ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সভাপতি নুরুল মোস্তফা বজলকে ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ক্ষমতাসীন দলের এমপি প্রার্থী মামুনের লোকজন গুলি করে কুপিয়ে-কুপিয়ে হত্যা করে। ময়মনসিংহের পাগলা থানার পাইথল ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ডা. হারুনুর রশীদকে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি প্রকাশ্যে কুপিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে।