বাড়ি রাজনীতি বিএনপি শিগগির বিএনপিতে পালাবদল আসছে!

শিগগির বিএনপিতে পালাবদল আসছে!

0
শিগগির বিএনপিতে পালাবদল আসছে!

বিএনপিতে পালাবদল আসছে। দলের নেতৃত্বের এই পালাবদলের ছোঁয়া লাগছে সর্বোচ্চ স্তর থেকে প্রবাসী শাখা পর্যন্ত। সরকারকে নতুন নির্বাচনে বাধ্য করতে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য দলের পুনর্গঠনের এসব চিন্তা-ভাবনা চলছে। ইতোমধ্যে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ-ধারায় যুক্ত দলগুলোর সর্বোচ্চ নেতারাও বিএনপির পুনর্গঠন-চিন্তার বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছেন। ২০১৮ ও ২০২৪ সালে পরপর দুটি নির্বাচনকালে দায়িত্বে থাকা একই নেতৃত্ব কেন ব্যর্থ হতে হলো, সে বিষয়টিও বিবেচনায় নিয়েছে বিএনপি।

বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র ও স্থায়ী কমিটির কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিগত কয়েক বছরের আন্দোলনের পরও দাবি মানানো সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে বিদায়ী বছরের ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ হাজার-হাজার নেতাকর্মী কারাগারে বন্দি। ওই অবস্থায় যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত দলগুলোর পরামর্শ ছাড়াই অবরোধ ও হরতাল দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় সিদ্ধান্ত-গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যারা যুক্ত ছিলেন, তাদের নিয়ে দলের সর্বোচ্চ পর্যায়েও অবগত রয়েছে।

বিদায়ী বছরের ২৮ অক্টোবর থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পরদিন (চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি) পর্যন্ত ৫ দফা হরতাল, ১৩ দফা অবরোধ ও ১৩ দফা গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি।

বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যুগপতে যুক্ত একাধিক দলের শীর্ষ নেতা জানান, বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে পুনর্গঠন করা হবে বলে তাদের নেতারা বলছেন। দল ও দলের রাজনৈতিক কর্মকৌশল নির্ধারণে বহুমত আছে বিএনপিতে। ফলে পুনর্গঠন, পুনর্বিন্যাস আসতে পারে। বিশেষ করে যারা আন্দোলনের কর্মসূচি নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছেন, নেতৃত্বে থেকেও যারা নিষ্ক্রিয় থেকেছেন, তাদের বিষয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের ‘অবজারভেশন’ আছে।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম একজন নেতা রবিবার (২৮ জানুয়ারি) বিকালে বলেন, ‘আন্দোলনের ব্যর্থতার প্রথম দায় বর্তায় দলটির এক নম্বরের ওপর। তিনি যদি ভারতের রাহুল গান্ধীর মতো দায়িত্ব থেকে সরে যেতেন, তাহলে তার সম্মান ও মর্যাদা আরও বেড়ে যেতো। যদিও আমাদের দেশে এর কোনও চর্চা নেই।’ সরকারকে নতুন নির্বাচনের দাবি মানাতে আন্দোলনের ধরন, কৌশলে পরিবর্তন আনতে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর চাপ বাড়ছে বলেও দাবি করেন এই নেতা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বলছেন, স্থায়ী কমিটিতে দল পুনর্গঠনের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে কাউন্সিল নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না বিএনপি।

দলের প্রভাবশালী একাধিক দায়িত্বশীল জানান, কাউন্সিলের প্রশ্ন এলেই বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিষয়টি সামনে চলে আসে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে। সেক্ষেত্রে কাউন্সিলের বিষয়টি প্রায় অনিশ্চিত। এক্ষেত্রে দলের শূন্য পদগুলোতে নিয়োগ হতে পারে। রদবদল আসতে পারে বিভিন্ন পদেও। এই রদবদল দলের অন্যতম শীর্ষ পদ থেকে শুরু করে প্রবাসে যারা দায়িত্বে ছিলেন— তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে।

২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ কাউন্সিলের পর দুই দফায় ৬০০ জনের বেশি সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করে বিএনপি। সেই সদস্যদের সংখ্যা কমে এখন ৫০২ জনে দাঁড়িয়েছে। বাকি ৯৮ জনের মধ্যে বেশিরভাগই মারা গেছেন। আবার কেউ কেউ বহিষ্কৃত হয়েছেন, কেউবা দল থেকে পদত্যাগ করেছেন।

বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির সদস্যের মধ্যে মারা গেছেন— তরিকুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অব. হান্নান শাহ। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আছেন স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন (বিদেশে চিকিৎসাধীন) ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। বয়োবৃদ্ধ দলের সবচেয়ে প্রবীণ নেতা ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারও প্রায় বিশ্রামে।

সক্রিয়দের মধ্যে কেবল মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী (কারাগারে) এবং গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান রয়েছেন। দেশের বাইরে রয়েছেন ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও সালাহউদ্দিন আহমেদ।

‘আমাদের নেতৃত্বে কোনও সংকট হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না’ বলছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান। তার ভাষ্য, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছি বর্তমান নেতৃত্ব ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অধীনেই। তিনি আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন। মতামত গ্রহণ করেন। যেহেতু বেগম জিয়া অসুস্থ, তাই আমাদের দলে যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।’

সেলিমা রহমান আরও বলেন, ‘ড. মোশাররফ হোসেন অসুস্থ, সত্যিই আমরা তাকে অনুভব করি। কিন্তু আমাদের তো সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘স্থায়ী কমিটির শূন্যপদগুলো অবশ্যই পূরণ হবে। কিন্তু দলে নানা সমস্যা রয়েছে। আমরা দল পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেও সম্পন্ন করতে পারিনি। একটি ভালো সময়ের অপেক্ষা করছি আমরা। আমাদের পুনর্গঠনের কাজও প্রায় শেষ করে এনেছিলাম। কিন্তু আন্দোলন, সরকারের নিপীড়নের কারণে পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির দুই জন সদস্য বলছেন, ইতোমধ্যে স্থায়ী কমিটিতে জায়গা পাওয়ার মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রবীণ ও নবীন নেতার নাম ভেতরে-ভেতরে আলোচনায় এসেছে। এদের মধ্যে আবদুল আউয়াল মিন্টু, বরকত উল্লাহ বুলু, মো. শাহজাহান, রুহুল কবির রিজভী আহমেদ, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী অ্যানি, জহির উদ্দিন স্বপন উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান মেজর অব. হাফিজ উদ্দিন আহমেদের নামও উঠে আসছে কারও কারও আলোচনায়।

স্থায়ী কমিটির একজন নেতা বলেন, ‘স্থায়ী কমিটির শূন্যপদে নিযুক্তির ক্ষেত্রে তারেক রহমান চাপে রয়েছেন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার পর সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে নিয়োগ দেন স্থায়ী কমিটিতে, এরপর আর কাউকে দেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় নতুন সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে শীর্ষ নেতার ওপর প্রবল চাপ, সেটা হচ্ছে সদস্য করার চাপ।’ ‘অনেকেই মনে মনে স্থায়ী কমিটির সদস্য হয়ে বসে আছেন’, বলেও মন্তব্য করেন এই নেতা।

কবে নাগাদ শূন্যপদে নিযুক্তি হতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে স্থায়ী কমিটির একজন নেতা বলেন, ‘ফোরামে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু হয়নি। বিষয়টি শীর্ষ নেতৃত্বের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়ে আসছে। ফলে, কবে নাগাদ তিনি এই সিদ্ধান্ত দেবেন— তা এখনও স্পষ্ট নয়।’

বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের ‘মুখ’ কে?

বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সরাসরি নেতৃত্বের অংশগ্রহণের কোনও বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে না ফিরলেও তার স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান বা পরিবারের অন্য কোনও সদস্যকেই এগিয়ে আসতে হবে, বলে মনে করে দায়িত্বশীল সূত্রটি।

জিয়া পরিবারের কোনও সদস্য না এলে কারাগারে বন্দি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেই স্বাভাবিকভাবে বিরোধী দলের আন্দোলনের ‘মুখ’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর সিনিয়র নেতারাও মনে করছেন, মির্জা ফখরুল জামিন পাওয়ার পর আন্দোলন-কর্মসূচিতে নতুন ধাক্কা সৃষ্টি হবে।

গণতন্ত্র মঞ্চের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চসহ একাধিক রাজনৈতিক জোটের নেতারা মির্জা ফখরুলের মুক্তির অপেক্ষা করছেন। নীতিগত প্রশ্নে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে— তা ঠিক করতে আপাতত ফখরুলের দিকেই তাকিয়ে আছেন নেতারা।

আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রসঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার ভাষ্য, ‘‘দুই দিক থেকে বিষয়টা বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রথমত, প্রচণ্ড সরকারি নিষ্পেষণে আন্দোলন আটকে গেলো। দ্বিতীয়ত, মানুষ ঘুরে দাঁড়ালো। হয়তো ক্ষয়ক্ষতি হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘তাহরির স্কয়ার’ বা মিয়ানমারের মতো জিতে গেলো। কোন পথ বেছে নেবেন, তা নেতৃত্ব ঠিক করবে।’’

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি উল্লেখ করেন, ‘কৌশলগতভাবে একটি কথা বলা হয়, সেই সেনাপতি যোগ্য যে কম রক্তপাতে যুদ্ধ জয় করতে পারে। আবার এও সত্য যে, এই কৌশল করতে গিয়ে সুবিধাবাদের খপ্পরে পড়ে আন্দোলনের মৃত্যু হতে পারে। এরকম একটি জটিল সময়ে আন্দোলনকারীরা কী করবে? কী সিদ্ধান্ত নেবেন তারা? নিশ্চয়ই সিদ্ধান্তহীনতায় আন্দোলনের মৃত্যু ঘটাবে না। আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তিত হতে পারে। কিন্তু মূল আন্দোলন থেকে সরে যাবে না। তার জন্য যে মূল্য দিতে হয়, তাও দিতে হবে।’

মান্না বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্র মঞ্চসহ খুব পজিটিভ। আমরা আন্দোলন চালিয়ে নিতে চাই। যুগপৎ ধারায় কর্মসূচি চাই। টাইম ইজ টু ফাইট।’

গণতন্ত্র মঞ্চের আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা সাইফুল হক বলেন, ‘বিএনপির প্রধান নেতারা জেলে থাকায়, অনেক নেতা দেশের বাইরে থাকায় রাজপথের প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে সমস্যা হয়েছে। আশা করি, আগামীতে কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যাবে, তা নিয়ে আমরা আলাপ করছি।’

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘৭ জানুয়ারির পর দেশে নতুন প্রেক্ষিত উপস্থিত হয়েছে। এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নির্বাচনের প্রতি মানুষ যে অনাস্থা জানিয়েছে, সেটিকে রাজপথের আন্দোলনে শামিল করা। এটাই বিরোধী দলগুলোর মূল চ্যালেঞ্জ। আমরা আন্দোলনের সাফল্য, ব্যর্থতা পর্যালোচনার পাশাপাশি সমস্যাগুলোও চিহ্নিত করছি।’

সাইফুল হক আরও বলেন, ‘আন্দোলনই নতুন নেতৃত্ব তৈরি করে। সরকার যখন সবকিছু প্রবল নিয়ন্ত্রণ করে, তখন নিজে থেকেই নেতা তৈরি হয়। সারা পৃথিবীতে একই অভিজ্ঞতা। আশা করি, আমরা এই ঘাটতি দূর করতে পারবো। সিদ্ধান্তমূলক বিষয়গুলোকে কীভাবে গণতান্ত্রিক করবো, লিয়াজোঁ কমিটি যেন আরও সক্রিয় হয়— সেটাকে আরও কার্যকর ঐক্য ও বোঝাপড়ার দিকে নিতে পারি। নেতৃত্বের দুর্বলতার ঘাটতি পরিস্থিতির পরিবর্তনে দূর হবে বলে প্রত্যাশা রাখি।’