বাড়ি বাংলাদেশ জাতীয় লতিফ সিদ্দিকী হচ্ছেন কী বিরোধী দলের নেতা?

লতিফ সিদ্দিকী হচ্ছেন কী বিরোধী দলের নেতা?

1
লতিফ সিদ্দিকী হচ্ছেন কী বিরোধী দলের নেতা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর গত বুধবার নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা এবং পরদিন বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৩৭ সদস্যের মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেছেন। ইতোমধ্যে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টনও হয়ে গেছে। এখন অপেক্ষা দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনের। তবে এই সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে কারা বসবেন, কে হবেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা- এ প্রশ্ন এখন জোর পাচ্ছে। সংসদের বিরোধী ভূমিকায় কোনো দল থাকবে নাকি স্বতন্ত্র এমপিদের নিয়ে মোর্চা হবে- বিষয়টি এখনো স্পষ্ট হয়নি। আবার সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা কে হবেন এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছে মিশ্র আলোচনা।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগের ২২২ জন, জাতীয় পার্টির (জাপা) ১১ জন এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পেয়ে নির্বাচিত ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন দল থেকে মাত্র তিন জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতাসীন দলের পরেই যে দলের অবস্থান থাকবে সেটি বিরোধী দলে যাবে। সে অনুযায়ী ১১টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও দলটির মহাসচিব গত দুই মেয়াদের মতো এবারও

সরকারের বিরোধী দলে থাকার ইচ্ছা পোষণ করেছেন। এ বিষয়ে তিনি আত্মবিশ্বাসীও। তবে আসন সংখ্যায় আওয়ামী লীগের পরই আছেন ৬২ স্বতন্ত্র এমপি। এসব স্বতন্ত্র প্রার্থী মোর্চা গঠন করে চাইলে তারা বিরোধী দল হতে পারে বলে জানা গেছে।

মূলত নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরপরই সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা কারা পালন করবেন- এ প্রশ্ন ওঠে গুরুত্বের সঙ্গে। বিশেষ করে সংসদে বর্তমান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির আসন সংখ্যা কমে যাওয়া এবং রেকর্ডসংখ্যক ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হওয়ায় প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ মাত্র ১১ জন সংসদ সদস্য নিয়ে জাপার বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকা বিধিসম্মত কিনা- এ প্রশ্ন যেমন ওঠে, তেমনি স্বতন্ত্ররা বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকতে পারবেন কিনা, এবং পারলেও কী উপায়ে থাকবেন- এ নিয়ে কৌতূহল দেখা দেয়। এমন প্রেক্ষাপটে এরই মধ্যে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা ও বিরোধীদলীয় নির্বাচিত করার মতো বিষয়টি সংবিধানে উল্লেখ নেই। যা আছে, তা সংসদীয় পদ্ধতি মাত্র। আর স্বতন্ত্ররা চাইলে মোর্চা গঠন করে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকতে পারবেন বলে তারা জানান।

আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, দলের একটি বড় অংশ চাইছে লতিফ সিদ্দিকীকে প্রধান করে মোর্চা করতে। অন্যদিকে কল্যাণ পার্টিকে নিয়ে স্বতন্ত্রের সঙ্গে মোর্চা করে বিরোধী দল করার বিষয় নিয়েও আলোচনা আছে। সে ক্ষেত্রে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমকে বিরোধীদলীয় প্রধান করার বিষয়টি নিয়েও দলে কথা হচ্ছে। নির্বাচনে ইবরাহিম কক্সবাজার-১ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। সংসদে দলটির এই একটি আসনই রয়েছে।

সংসদে নিজেদের বিরোধী ভূমিকায় রাখার বিষয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘আমরা তো বিরোধী দলেই আছি। দেখা যাক কী হয়। দলে বিষয়টি নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হয়নি।’ অন্য দিকে স্বতন্ত্র এমপিরা জোট গঠন করবেন বলে জানিয়েছেন ফরিদপুর-৪ আসনের মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। তার ভাষ্য, ‘এখনো বিরোধী দল গঠন হয়নি। আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেব। আমরা জোট অবশ্যই করব।’ ফরিদপুর-৩ আসন থেকে জয়ী স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য এ.কে. আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘স্বতন্ত্র সবাই একত্রে থাকব, এ রকম একটা প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।’ স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচনী নেত্রকোনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য ইফতিকার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু আমাদের সময়কে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কথাই শেষ কথা। এর বাইরে আমার কোনো বক্তব্য নাই।’

অবশ্য অধিকাংশ স্বতন্ত্র প্রার্থী বিরোধী ভূমিকায় না যাওয়ার পক্ষে। সারাদেশের অন্তত ১৫ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে কথা হয়। তাদের ভাষ্য, তারা দলের অনুমতিতেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছে। দলের বিরোধী তকমা তারা গায়ে লাগাতে চান না।

সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ২ (১) (ট) ধারায় বলা আছে, বিরোধীদলীয় নেতা অর্থ হলো, ‘স্পিকারের বিবেচনামতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমতে দল বা অধিসঙ্গের নেতা।’

এ বিষয়ে সাবেক সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের কমপ্লেইন্ট অ্যান্ড ভিজিলেন্স কমিটির সভাপতি সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় কোন দল হবে সে বিষয়ে সংবিধানে কিছু বলা নেই। এটি পার্লামেন্টারি সিস্টেম। তিনি বলেন, সেখানে কারা কতটি আসনে জয়ী হয়েছেন, ৭ বা ১০টি বিষয় না। এমনকি বিজয়ী স্বতন্ত্রদের মধ্য থেকে যদি কোনো মোর্চা বা জোট করা হয়, তারাও বিরোধী দলের ভূমিকায় আসতে পারেন।

এ প্রসঙ্গে একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, কবি ও প্রাবন্ধিক দৈনিক আমাদের সময়ের সম্পাদক আবুল মোমেন গত ৮ জানুয়ারি প্রকাশিত এক বিশেষ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ভারতে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে ১৯৫৯ সালে সেদেশের প্রবীণ রাজনীতিবিদ চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারি গঠন করেছিলেন স্বতন্ত্রী পার্টি। তার সাথে ছিলেন বিখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ মিনু মাসানি, তরুণ রাজনীতিক পিলু মোদি প্রমুখ। গোপালাচারি মনে করতেন জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস ক্রমেই বামপন্থি দলে পরিণত হচ্ছে। তাই তিনি মধ্য ডানপন্থি দল হিসেবে স্বতন্ত্র পার্টি গঠন করেছিলেন। দলটি ১৯৭৪ সন পর্যন্ত সক্রিয় ছিল, পরে ভারতীয় লোকদলের সঙ্গে একীভূত হয়। এদেশে অনেকের প্রত্যাশা হলো মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশের বিরোধী দলও হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাসে বিশ্বাসী ও তাতে দায়বদ্ধ। আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে এদেশের স্বতন্ত্র দল এমন ভূমিকা পালন করতে পারে। এখানে হয়তো সমালোচনাটা হতে পারে যে বর্তমান আওয়ামী লীগ ক্রমেই দক্ষিণপন্থা ও রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। তার বিকল্প মধ্যবাম দল গঠন হবে এখন ইতিহাসের দাবি।’

জানা গেছে, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩ আসনে জয়ী হয়। জাসদ ও জাতীয় লীগ একটি করে আসন পায়। স্বতন্ত্র এমপিরা জয়ী হন ৫টি আসনে। স্পিকার এই ৭ এমপির জন্য সংসদে কক্ষ বরাদ্দ দিলেও তাদের সংসদীয় দল বা অধিসংঘের স্বীকৃতি দেননি। জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খানকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আবেদন জানান ৭ এমপি।

১৯৭৩ সালের ১২ এপ্রিল সংসদে এক বিতর্কে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘পাঁচ-সাতজন সদস্য নিয়ে গঠিত কোনো গ্রুপ নেতাকে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না। ২৫ জনের কম সদস্য নিয়ে কোনো দল গঠিত হলে এবং ওই দলে কমপক্ষে ১০ জন সদস্য থাকলে, ওই দলকে সংসদীয় অধিসংঘ বা পার্লামেন্টারি গ্রুপ বলা যেতে পারে, কিন্তু সংসদীয় দল বলা যাবে না।’ তাই প্রথম সংসদে স্বীকৃত বিরোধী দল ছিল না। এরপর থেকে সংবিধানে বিরোধী দলের আসনের বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকলেও বঙ্গবন্ধুর কথামতো বিরোধী দল হওয়ার জন্য ২৫ জন নির্বাচিত সংসদ সদস্য থাকার রেওয়াজটি সব সময়েই আলোচনায় থাকে।

স্বতন্ত্রের বিষয়টি ১৯৮৮ সালে ‘বিতর্কিত’ চতুর্থ জাতীয় নির্বাচনের পরও এই চিত্র দেখা গিয়েছিল। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি এককভাবে ২৫১টি আসনে জয় পেয়েছিল। অন্যদিকে জাসদের নেতৃত্বে কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি পেয়েছিল ১৯টি আসন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছিল ২৫টি আসন। এ ছাড়া জাসদ তিনটি এবং ফ্রিডম পার্টি দুটি আসন পায়। ওই নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় পার্টি ক্ষমতা গ্রহণ করে। ফ্রিডম পার্টি ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের সমর্থন নিয়ে আ স ম আব্দুর রব সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে কারণে তাকে ‘গৃহপালিত’ বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে ৩৪ আসন পেয়ে প্রধান বিরোধী দল হয়েছিল জাপা। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে বিএনপির প্রায় চার গুণ ২২ আসন পেয়ে ফের বিরোধী দল হয় দলটি। এবারও বিএনপিবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে জাপা। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভিড়ে দলটি পেয়েছে মাত্র ১১ জন সংসদ সদস্য।

২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী ১৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলে হাজী সেলিমের নেতৃত্বে একটি জোট তৈরি করতে দেখা গিয়েছিল। সেই জোটকে আনুপাতিক হারে তিনজন সংরক্ষিত নারী সদস্যের কোটাও দেওয়া হয়েছিল। সাড়ে তিন বছর পর অবশ্য সেই জোটের নেতা হাজী সেলিমসহ বেশির ভাগ স্বতন্ত্র প্রার্থী আবার আওয়ামী লীগে ফিরে যান।

প্রনঙ্গত গত ১০ বছরে ভারতে বিরোধীদলীয় নেতা নেই। কারণ দেশটিতে নিয়ম আছে, লিডার অব দ্য অপজিশন হতে হলে কমপক্ষে ১০ শতাংশ আসন থাকতে হবে। কংগ্রেসের ১০ শতাংশের কম আসন আছে।