বাড়ি রাজনীতি জাতীয় পার্টি খুঁজে পাচ্ছে না প্রার্থীরা জাপা চেয়ারম্যান-মহাসচিবকে

খুঁজে পাচ্ছে না প্রার্থীরা জাপা চেয়ারম্যান-মহাসচিবকে

0
খুঁজে পাচ্ছে না প্রার্থীরা জাপা চেয়ারম্যান মহাসচিবকে

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের শেষ সপ্তাহে এসে আবারও নাটকীয়তা চলছে জাতীয় পার্টিতে (জাপা)। জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে খুঁজে পাচ্ছে না দলীয় প্রার্থীরা। কেবল তা-ই নয়, নির্বাচন পরিচালনা করতে জাপা যে কমিটি গঠন করেছে সেই কমিটির সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ নেই দলের দুই শীর্ষ নেতাদের।

জি এম কাদের গত শুক্রবার থেকে নিজ নির্বাচনী এলাকা রংপুর ৩-এ অবস্থান করছেন। অপরদিকে মহাসচিব চুন্নু ইশতেহার ঘোষণার পর নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করতে নিজ এলাকা কিশোরগঞ্জে গিয়ে আর ঢাকায় ফিরে আসেননি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা।

অপরদিকে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা দলীয় প্রার্থীদের ভোটে জেতাতে একের পর এক সমাবেশ করে যাচ্ছেন। সিলেট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। এরপর বরিশাল, মাদারীপুর, রংপুর, ফরিদপুরে জনসভায় যোগ দিয়ে দলীয় প্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। নৌকায় ভোট চেয়েছেন। পাশাপাশি ভার্চুয়াল সমাবেশেও যুক্ত হচ্ছেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ অন্য নেতারাও নিজ আসন রেখে দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে বিভিন্ন এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। কিন্ত একেবারেই বিপরীত চিত্র বিরোধী শিবির জাপায়। এখন পর্যন্ত জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে কোনো নির্বাচনী জনসভায় যুক্ত হতে দেখা যায়নি। এমনকি নিজ নির্বাচনী এলাকায়ও তিনি নামমাত্র প্রচারণা চালাচ্ছেন। বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে জাপা প্রার্থীরা চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছেন।

সবশেষ শুক্রবার ঢাকা থেকে সড়কপথে রংপুরে রওনা দেন জি এম কাদের। জাপার দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, জি এম কাদেরকে রংপুর যাওয়ার পথে টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও গাইবান্ধার নির্বাচনী এলাকাগুলোয় জনসভায় করার বিষয়ে প্রেসিডিয়াম মেম্বাররা অনুরোধ করেছিলেন। কিন্ত চেয়ারম্যান বলেন, আওয়ামী লীগের জনভায় লাখ লাখ মানুষ অংশ নিচ্ছে। আমাদের জনসভায় মানুষ পাবেন কই? পরবর্তীতে এসব নেতারা পথসভা করতে পরামর্শ দিলেও তিনি গুরুত্ব দেননি।

একই অভিযোগ টাঙ্গাইলের এক প্রার্থীর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রার্থী বলেন, ‘আমরা টাঙ্গাইল অথবা সিরাজগঞ্জে একটি জনসভা করতে দলের শীর্ষ নেতাদের অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কিন্ত এখন পর্যন্ত আমাদের এই প্রস্তাবে শীর্ষ নেতারা সাড়া দেননি।’

জি এম কাদের রংপুরে ফিরেই পরদিন শনিবার আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন। নির্বাচনে ভোটার নিয়ে আসা ও তার সমর্থনে আওয়ামী লীগ নেতাদের কাজ করতে অনুরোধ জানান তিনি। এরপর থেকে এলাকায় অবস্থান করলেও তাকে কোনো জনসভা করতে দেখা যায়নি। কেবল সাংবাদিকদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা বলা ও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে বাসায় বৈঠক করছেন।

কুড়িগ্রাম, রংপুর, লালমনিরহাট থেকে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন জাপার এমন একাধিক প্রার্থী বলেন, উত্তরবঙ্গে জাপা শক্তিতে এগিয়ে আছে। ৩৩টি আসনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আসন পাবে জাপা। আমাদের চেয়ারম্যান এসব এলাকায় জনসভা করলে দলীয় নেতাকর্মী ও ভোটাররা উজ্জীবিত হবে।

চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনের জাপা প্রার্থী মোহাম্মদ ছালেম বলেন, ‘গত ১ সপ্তাহ ধরে চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি ক্রমাগত। কিন্ত তারা ফোন রিসিভ করছেন না, কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই। নির্বাচনের আগে দল নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রাখছে না।’

জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা বলেন, ‘আমাদের চেয়ারম্যান জি এম কাদের নানামুখী চাপে রয়েছেন, ফলে তার মন ভালো নেই। প্রার্থীরা নির্বাচন করতে গিয়ে নানা চাপে পড়ছেন। প্রশাসন আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করছে, আমাদের প্রার্থীরা হামলার শিকার হচ্ছে। সরকার যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের নির্বাচনে নিয়ে এসেছিল তার একটাও রাখেনি। ফলে এই নির্বাচন নিয়ে সংশয় রয়েছে। নির্বাচন এলোমেলো ও দলীয় নিয়ন্ত্রিত। শুরু থেকেই চেয়ারম্যান নির্বাচনে আসার পক্ষে ছিলেন না, তাকে চাপ দিয়ে আনা হয়েছে। সরকার তার প্রতিশ্রুতি না রাখলে নির্বাচনে থাকা নিয়ে সন্দেহ আছে।’

চেয়ারম্যান ও মহাসচিব প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না কেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন করতে অনেক খরচ ও আনুষঙ্গিক বিষয় আছে। প্রার্থীরা ফোন দিয়ে আর্থিক সহযোগিতা চাচ্ছে, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা কামনা করছে। এসব চাপ চেয়ারম্যান নিতে পারছেন না, ফলে তিনি বিরক্ত।’

কিশোরগঞ্জ-৩ আসন থেকে সবশেষ তিন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সংসদ সদস্য হয়েছেন। কিন্ত এবার তার সঙ্গে কাজ করতে রাজি হচ্ছেন না স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। আওয়ামী লীগ নেতারা এবার যেকোনো মূল্যে আসনটি পুনরুদ্ধার করতে স্বতন্ত্রদের পক্ষে কাজ করছেন। এবার মুজিবুল হক চুন্নুর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাঠে আছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ড. মিজানুল হক। তার পক্ষে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা থাকায় দুশ্চিন্তায় ঘুম হারাম হচ্ছে জাপা মহাসচিবের। প্রথম দিকে তিনি কৌশলে অনুসারীদের দিয়ে জাপা প্রার্থী ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত লিখিয়েছিলেন। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা।

জাপা এবার নির্বাচন পরিচালনা করতে যে কমিটি করেছিল তার আহ্বায়ক করা হয় মুজিবুল হক চুন্নুকে। নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা মুজিবুল হক চুন্নু এলাকায় যাওয়ার পর থেকে প্রার্থী তো দূরের কথা, দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছেন না। এ নিয়ে বিরক্ত দলের সিনিয়র নেতারাও।

রাজশাহী-২ আসনের জাপা প্রার্থী সাইফুল ইসলাম স্বপন বলেন, ‘আমাদের দল একটা নির্বাচন মনিটরিং টিম করেছিল। কিন্ত তারা কোনো খোঁজ প্রার্থীদের নেন না। আমরা কী করছি, কীভাবে নির্বাচনের মাঠে আছি তা দলের পক্ষ থেকে জানার কেউ নেই। আমাদের দল থেকে যে সহযোগিতার কথা বলা হয়েছিল সে বিষয়েও দলের কোনো কার্যক্রম নেই।’

জাপার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ও প্রেসিডিয়াম মেম্বার জহিরুল ইসলাম জহির বলেন, ‘চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু নিজ নির্বাচনী এলাকায় থাকায় তাদের সঙ্গে আমাদের কিংবা প্রার্থীদের যোগাযোগ হচ্ছে না। এ নিয়ে প্রার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, তাদের নানা দাবি ও চাহিদার কথা জানাচ্ছেন যা চেয়ারম্যান-মহাসচিব ছাড়া কেউ পূরণ করতে পারব না। তবে মহাসচিব প্রতিদিন রাতে একবার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে খোঁজ নেন। আমি তাকে সব বিষয় জানাচ্ছি।’

এদিকে দ্বাদশ নির্বাচনে যে ২৬৫ জন প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন তাদের মধ্যে ১০০-এর বেশি আসন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন জাপা প্রার্থীরা। প্রতিদিনই কেউ না কেউ ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। সবশেষ মঙ্গলবার দিনাজপুর-২ আসনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন জাপা প্রার্থী মো. মাহবুব আলম ও গাজীপুর-৪ আসনের প্রার্থী সামসুদ্দিন খান। সামসুদ্দিন খান শারীরিক অসুস্থতা ও আর্থিক সংকটের কারণ জানিয়ে নির্বাচন থেকে সরে যান।

এর আগে সোমবার নির্বাচন থেকে সরে দাড়ান হবিগঞ্জ-২ আসনের (বানিয়াচং আজমিরীগঞ্জ) প্রার্থী শংকর পাল। তিনি বলেন, ‘প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ ও তার গড়া জাপাকে ভালোবাসি বলে এখনও দল করি। জাপার মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থিত পোস্টার ছাপিয়ে ভোট চাওয়ার লোক আমি নই। তাহলে দলের অবস্থান কোথায় থাকল? আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে সাধারণ মানুষের ভোট পাওয়া যাবে না।’