ক্রিকেটখেলা

পেসারদের তোপে নিউজিল্যান্ডে ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ

রেকর্ডটা বারবার টিভি স্ক্রিনে ভেসে উঠছিল। সঙ্গে ধারাভাষ্যকার মার্ক রিচার্ডসনের কণ্ঠ। ঘরের মাঠে টানা সর্বোচ্চ ১৮ ওয়ানডে জয়ের রেকর্ডটা অস্ট্রেলিয়ার। বাংলাদেশের বিপক্ষে জিতলেই নিউজিল্যান্ড সে রেকর্ড স্পর্শ করবে। সিরিজ জয়ের কাজটা প্রথম দুই ম্যাচ জেতায় আগেই সেরে ফেলেছে কিউইরা। শেষ ম্যাচে তাদের লক্ষ্য ধবলধোলাই ও সংখ্যাটাকে ১৭ থেকে ১৮-তে নেওয়া, অস্ট্রেলিয়ার রেকর্ডে ভাগ বসানো।

বাংলাদেশ দলও একটা রেকর্ড বদলাতে চাইছিল। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ১৮টি ওয়ানডে খেলা বাংলাদেশ সব কটিতে হেরেছে। সিরিজের শেষ ম্যাচের আগে দুই দলের স্কোরলাইনটা এমন—নিউজিল্যান্ড ১৮-০ বাংলাদেশ। নিউজিল্যান্ডে প্রতিটি ম্যাচে খেলতে নামার আগে যে প্রথম জয়ের খোঁজে থাকে বাংলাদেশ, আজও সে লক্ষ্যেই খেলতে নেমেছিল নাজমুল হোসেনের দল। অবশেষে সে লক্ষ্যে সফল হলো। নিউজিল্যান্ডকে তাদের মাটিতে প্রথমবারের মতো ওয়ানডেতে হারাল বাংলাদেশ।

নেপিয়ারের ম্যাকলিন পার্কের কন্ডিশনকে এক কথায় পেস–স্বর্গ বলা যায়। পেস, বাউন্স, সুইং ও সিম মুভমেন্টের এই কন্ডিশনে পেসারদের উল্লাসনৃত্য দেখা যাবে—এমনই ছিল প্রত্যাশা। বাংলাদেশের পেসাররা তা মিটিয়েছেন নিজেদের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো প্রতিপক্ষের ১০ উইকেটই নিয়ে। শরীফুল-তানজিমের আগুনে বোলিংয়ে কিউইদের ইনিংস থামে ৩১.৪ ওভারে ৯৮ রানে। ২০০৭ সালের পর ঘরের মাঠে কিউইদের যেটি সর্বনিম্ন স্কোর, যা ১ উইকেট হারিয়ে টপকে যায় বাংলাদেশ।

ওয়ানডে সিরিজের পর এই দুই দল খেলবে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ। ছোট্ট লক্ষ্যে খেলতে নেমে মনে হতে পারে বাংলাদেশ ২০ ওভারের খেলার প্রস্তুতিটাও সেরে নিল! উদ্বোধনে নামা সৌম্য সরকার ইনিংসের শুরুতে চোখের সমস্যায় ভুগছিলেন। পানি দিয়ে, ফিজিওর প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েও ঠিক হচ্ছিল না। এরপর ১৬ বলে ৪ রান করে মাঠ ছাড়েন। সৌম্যর ওপেনিং–সঙ্গী এনামুল হক অবশ্য ইনিংসের শুরুর চাপটা কাউকে অনুভব করতে দেননি। নিউজিল্যান্ডের বোলাররা উইকেটের আশায় আক্রমণাত্মক বোলিং করার চেষ্টা করেছেন। তিনিও ব্যাট চালিয়ে গেছেন। ইনিংসের ১৩তম ওভারে তিনি যখন আউট হন, তখন ম্যাচটা বাংলাদেশের হাতের মুঠোয়। দলের রান ১ উইকেটে ৮৪, যার মধ্যে ৩৩ বলে ৭টি বাউন্ডারিতে এনামুলের রান ৩৭।

বাকি কাজটা করেছেন নাজমুল নিজেই। সৌম্যর মাঠ ছাড়ার পর দ্রুত রান তুলেছেন তিনিও। জয়সূচক রানটাও এসেছে তাঁর ব্যাট থেকে। আদি অশোকের করা ইনিংসের ১৬তম ওভারের প্রথম বলটাকে কাভারে ঠেলে নাজমুল দৌড়ে ২ রান নিলে নিউজিল্যান্ডের ছোট্ট লক্ষ্য টপকে যায় বাংলাদেশ। ওই ২ রানে ক্যারিয়ারের অষ্টম ওয়ানডে অর্ধশতকও স্পর্শ করেন নাজমুল। নাজমুল শেষ পর্যন্ত ৪২ বলে ৫১ রানে অপরাজিত ছিলেন, ৮টি বাউন্ডারি ছিল নাজমুলের ইনিংসে।

তবে স্মরণীয় জয়ে কৃতিত্ব যতটা না ব্যাটসম্যানদের, তার চেয়ে বেশি বোলারদের। গতিময় বাউন্সি উইকেট পেয়ে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং রীতিমতো গুঁড়িয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ দলের পেসাররা। বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক নাজমুল হাসান তাঁর চাহিদাটা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন টসের সময়। উইকেটে ঘাস আছে। আছে বাউন্সও। আর সকালবেলায় কন্ডিশনে সুইং তো থাকবেই। বাংলাদেশ তা কাজে লাগাতে চায়। সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল, তা বোঝা যাচ্ছিল ইনিংসের শুরু থেকেই। শরীফুল ও তানজিমের প্রথম ওভারের কিছু বল মুশফিক ধরেছেন মাথা বরাবর। ইনিংসের চতুর্থ ওভারেই তানজিমের বলে ব্যাট ছুঁইয়ে মুশফিকের গ্লাভসে ধরা পড়েন ওপেনার রাচিন রবীন্দ্র (১২ বলে ৮)। নিউজিল্যান্ডের স্কোরবোর্ডে তখন ১৬ রান।

উইকেট পতন তো আছেই; সঙ্গে দুই প্রান্তের আঁটসাঁট বোলিংয়ে রানও আসছিল না কিউইদের। ইনিংসের অষ্টম ওভারে তার ফল পেয়ে যায় বাংলাদেশ। সেটাও তানজিমের হাত ধরে। ক্রস সিমে করা অফ স্টাম্পের বাইরের বলে টেনে মারতে গিয়ে মিডউইকেটে ক্যাচ তোলেন তিনে নামা হেনরি নিকোলস (১২ বলে ১ রান)। নতুন বলে জোড়া ধাক্কাটা অবশ্য ধীরস্থির ব্যাটিংয়ে কিছুটা কাটিয়ে উঠেছিল নিউজিল্যান্ড। টম ল্যাথাম ও উইল ইয়াং ধরে খেলে পাওয়ারপ্লের (২৭ রান) সময়টা পার করেন। কিন্তু প্রথম স্পেলে এলোমেলো বোলিং করা শরীফুলকে ড্রিংকস ব্রেকের পর দ্বিতীয় স্পেলে ফিরিয়ে আনেন নাজমুল, ব্রেকথ্রু আসে তাতেই।

লাইন-লেংথের ধারাবাহিকতায় পিছিয়ে থাকা সেই শরীফুলই এক স্পেলে ৩ উইকেট নিয়ে ম্যাচের ছবিটা পাল্টে দেন। দুর্দান্ত এক ওবল সিম ডেলিভারিতে অভিজ্ঞ ল্যাথামের স্টাম্প ভাঙেন তিনি। এরপর ফুললেংথ থেকে অ্যাঙ্গেলে বেরিয়ে যাওয়া বলে ড্রাইভ করতে গিয়ে পয়েন্টে মেহেদী হাসান মিরাজের হাতে ধরা পড়েন ৪৩ বলে ২৬ রান করা ইয়াং। নিউজিল্যান্ডের রান তখন ৪ উইকেটে ৬১। কিছুক্ষণ পরই আরও একবার শরীফুলের আঘাত। সদ্য ক্রিজে আসা মার্ক চ্যাপম্যানকে (২) ওবল সিমে করা বলে বোল্ড করেন এই বাঁহাতি। ওই স্পেলেই ৬৩ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বসে কিউইরা। সেখান থেকে কিউইদের আর ঘুরে দাঁড়াতে দেননি তানজিম। নতুন বলে দাপুটে বোলিং করা এ পেসারকে ফেরান নাজমুল, ২৩তম ওভারে নিউজিল্যান্ডের সর্বশেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান টম ব্লান্ডেলকেও (৪) ড্রেসিংরুমের পথ দেখান তিনি।

নিউজিল্যান্ডের রান তখন ৬ উইকেটে ৭০। কিউইদের নিচের সারির ব্যাটসম্যানরা রানটাকে তিন অঙ্কে নিতে দেননি সৌম্য সরকার। তাঁর ছোট ছোট মুভমেন্ট সামলাতে পারেনি জশ ক্লার্কসন, অ্যাডাম মিলনে ও আদি অশোক। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে উইলিয়াম ও’রর্ককে বোল্ড করে উইকেটশিকারিদের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন মোস্তাফিজুর রহমানও। পেসারদের এমন বোলিং পারফরম্যান্সে দলের মূল স্পিনার মিরাজকে করতে হয় মাত্র ১ ওভার, রিশাদ হোসেন ৩ ওভার। পেসারদের মধ্যে ৩টি করে উইকেট নিয়েছেন তানজিম, শরীফুল ও সৌম্য।

সংক্ষিপ্ত স্কোর

নিউজিল্যান্ড : ৩১.৪ ওভারে ৯৮

(ইয়াং ২৬, ল্যাথাম ২১, ক্লার্কসন ১৬, অশোক ১০; তানজিম ৩/১৪, সৌম্য ৩/১৮, শরীফুল ৩/২২, মোস্তাফিজ ১/৩৬)

বাংলাদেশ : ১৫.১ ওভারে ৯৯/১

(নাজমুল ৫১*, এনামুল ৩৭, সৌম্য ৪ আহত*, লিটন ১*; ও’রুরক ১/৩৩)

ফল : বাংলাদেশ ৯ উইকেটে জয়ী।

ম্যান অব দ্য ম্যাচ : তানজিম হাসান।

সিরিজ : নিউজিল্যান্ড ২–১ ব্যবধানে জয়ী।

আরও দেখুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
এমপি আনার হত্যাকাণ্ডে ‘হানি ট্র্যাপ’ শিলাস্তি রহমান ‘Pushpa 2’ is coming to Bangladesh in Hindi ইব্রাহিম রাইসি যেভাবে ৫০০০ মানুষকে হত্যা করেছিলো