বাড়ি রাজনীতি আওয়ামী লীগ হায়রে রাজনীতি: ভোটের আগেই পরিত্যক্ত হলেন যারা

হায়রে রাজনীতি: ভোটের আগেই পরিত্যক্ত হলেন যারা

0
ভোটের আগেই পরিত্যক্ত হলেন যারা

‘ভুল সবই ভুল/এই জীবনের পাতায় পাতায়/ যা লেখা, সে ভুল/ প্রশ্ন করে নিজের কাছে কে আমি/ কোথায় ছিলাম, কোথায় যাব এই আমি’ (সুজাতা চক্রবর্তী)। গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর করা এ গান বাংলা ভাষাভাষি মানুষের হৃদয়ে গেঁথে রয়েছে। সেই গানই যেন দেশের কিছু লোভী, সুবিধাবাদী রাজনীতিকের বিধিলিপি হয়ে গেছে। এমপি-মন্ত্রী হওয়ার লোভে জনগণকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নতুন দল গঠন করে, অন্যদলে যোগদান করে এবং নানাভাবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেন। গণভবণে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এমপি মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন; তাদের স্বপ্ন নিমিষেই চূড়মার হয়ে গেছে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গণে কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিত পাওয়া তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট (বিএনএম) ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি) এবং ১৪ দলীয় জোটের শরীক কয়েকজন নেতা ‘নিজেরে হারায়ে খুঁজি’ গানের মতো অবস্থায় পড়ে গেছেন। ডাক ঢোল পিটিয়ে এমপি হওয়ার লোভে নির্বাচনের গেলেও ‘আসন সমঝোতায়’ কোনো নেতা পাত্তা পাননি।

১৭ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ‘ভিক্ষার আসন নিয়ে নির্বাচনে যাব না’ ঘোষণা দেয়ার তিন ঘন্টা পর ভিক্ষার ‘২৬ আসন সমঝোতা’ মেনে নিয়েই নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু তৃর্ণমূল বিএনপির শমসের মোবিন চৌধুরী, অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট (বিএনএম) শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর, ড. মুহাম্মদ শাহ্জাহান, কল্যাণ পার্টির মেজর জেনারেল (অব) সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমির আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজি ‘বিক্রি’ হলেও ‘আসন সমঝোতা’ করতে পারেননি। তারা কার্যত আওয়ামী লীগের কাছে কোনো পাত্তাই পাননি। হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, ফজলে হোসেন বাদশা, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু নিজেদের আসন ধরে রাখতে পারলেও দলীয় প্রতীকের প্রতি আস্থা হারিয়ে নৌকায় উঠেছেন। আসন ভাগাভাগিতে ‘হ্যাডম’ দেখাতে গিয়ে শিরিন আক্তার ফেনি-১ আসন খুঁইয়েছেন। সুবিধাবাদী এই নেতাদের অবস্থা হয়েছে এখন ‘নিজেরে হারায়ে খুুঁজি’।

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত লাখ করা এসব সুবিধাবাদী নেতার নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে কখনো গণভবন কখনো আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির কার্যালয়ে দৌঁড়ঝাপ শুরু হলে গণমাধ্যমে সাড়া পড়ে যায়। এ চিত্র দেখ গত ২ ডিসেম্বর সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) ড. সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন, ‘নির্বাচনে অনেকে দল ত্যাগ করে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন এবং সরকার অনেককে জোরপূর্বক নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করাচ্ছে এতে সরকারের যেমন উদ্দেশ্যে হাসিল হবে না; তেমনি যারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন তারা হয়তো আম ছালা দুটোই হারাবেন। আর সরকার হয়তো মনে করছে, গত দুটি নির্বাচন জনগণ মেনে নিয়েছিল এবারও হয়তো সেটি মেনে নেব। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এবার ছাড় দেবে না জনগণ।’

প্রতীক বরাদ্দের মাধ্যমে গতকাল নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়ে গেছে। মিলেমিশের এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে ২৬টি ও ১৪ দলের শরিকদের ৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। শরিকদের মধ্যে জাসদ ৩টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ২টি ও জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) একটি আসন পেয়েছে। কিন্তু ঢাকঢোল পিটিয়ে নির্বাচনের মাঠে নামা ‘তৃণমূল বিএনপি’, ‘বিএনএম’ ও ‘বিএসপি’ নেতাদের কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বারের গানের মতো ‘শুন্য হাতে আজ এসেছি নেই তো কিছুই আর/ অশ্রু ভেজা এ গান আমার দিলাম উপহার।’ এই দলগুলোর নেতাদের বেশির ভাগই নির্বাচনী এলাকায় আইন শৃংখলা বাহিনীর সহায়তা ছাড়া যেতে পারছেন না। নির্বাচনী প্রচারণায় কি হবে বোঝা না গেলেও বেশির ভাগ নেতাই জামানত রক্ষা করতে পারবেন না।

জানা যায়, নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপি ২৩০ আসনে মনোনয়ন জমা দিয়েছিল। আর বিএনএম ৮২ আসনে। তৃণমূল বিএনপির ১৩৯ ও বিএনএমের ৫৭ মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করে ইসি। কল্যাণ পার্টির অর্ধশতাধিক নেতা মনোনয়ন জমা দিলেও ইবরাহিম নিজ জেলা চট্টগ্রামের বদলে কক্সবাজার-১ আসনে প্রার্থী হয়েছেন। ওই নৌকার প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমদের প্রার্থীতা বাতিল হলেও বর্তমানের এমজি জাফর আলম ডামি প্রার্থী হিসেবে ভোটযুদ্ধে রয়েছেন। ফলে ইবরাহিমের সেখানে বিজয়ীয় হওয়া দূরের কথা প্রচারণা চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন শমসের মবিন চৌধুরী সিলেট-৬, মহাসচিব অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জ-১, নির্বাহী চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট অন্তরা হুদা মুন্সীগঞ্জ-১ এবং বিএনএমের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর ফরিদপুর-১, মহাসচিব ড. মুহাম্মদ শাহ্জাহান চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) ও দলটির সাবেক আহ্বায়ক ড. আবদুর রহমান বরগুনা-২ আসনে প্রার্থী হয়েছেন। এর একটি আসনেও আওয়ামী লীগ ছাড় দেয়নি।

সিলেট-৬ আসনে সমশের মোবিন চৌধুরীর বিপক্ষ্যে নৌকা প্রতীকে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী কানাডা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সরওয়ার হোসেন প্রার্থী হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে তৈমূর আলম খন্দকারের প্রতিদ্বন্দ্বীয় প্রার্থী আওয়ামী লীগের গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক, ডামি প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান ভূঁইয়া ও গোলাম দস্তগীর গাজীর ছেলে গোলাম মুর্তজা। মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে তৃর্ণমূলের অন্তরা হুদার বিরুদ্ধে নির্বাচনী যুদ্ধে নেমেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী মহিউদ্দিন আহম্মেদ, বিকল্পধারার প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মাহী বি. চৌধুরী এবং আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম সারোয়ার কবীর। ফরিদপুর-১ আসনে শাহ মো. আবু জাফরের বিরুদ্ধে ভোটের মাঠে নেমেছেন নৌকার প্রার্থী আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান, ডামি প্রার্থী কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সাবেক সহসভাপতি আরিফুর রহমান দোলন ও মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম। চাঁদপুর-৪ আসনে ড. মুহাম্মদ শাহ্জাহানের বিরুদ্ধে ভোটে প্রার্থী হয়েছেন নৌকা মার্কার বর্তমান এমপি শফিকুর রহমান। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের আরো দুই ডামি প্রার্থীর সাবেক এমপি ড. শামসুল হক ভূঁইয়া ও উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে পদত্যাগকারী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জাহিদুল ইসলাম রোমান রয়েছেন। বরগুনা-২ আসনে বিএনএমের সাবেক আহ্বায়ক ড. আবদুর রহমানের বিপক্ষ্যে সংসদ সদস্য সুলতানা নাদিরাসহ আরো বেশ কয়েকজন প্রাথী রয়েছেন। এসব আসনে লাঙ্গলের কোনো অস্থিত্ব নেই। ভোটযুদ্ধে নৌকার সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর লড়াই হবে। কিংস পার্টির নেতাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে মনে করছেন নির্বাচনী এলাকার ভোটাররা। চিরায়ত প্রবাদ রয়েছে, ‘লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু’। এমপি, মন্ত্রী হওয়ার লোভে পড়ে কেউ আন্দোলনের মাঠ থেকে পল্টি দিয়ে নির্বাচনে নেমেছেন, কেউ নতুন দল গঠন করে গণভবনে ‘এমপি হওয়ার নিশ্চয়তা’ নিয়ে নির্বাচনে নেমেছেন কোমড় বেঁধে, কেউ বিরোধী দলের নেতা হওয়ার খোয়াব দেখে নির্বাচনে নেমেছেন ঢাকঢোল পিটিয়ে। কিন্তু তারা ‘আসন সমঝোতা’য় পাত্তা পাননি; বরং আওয়ামী লীগ কর্তৃক পরিত্যাক্ত হয়েছেন।