বাড়ি রাজনীতি আওয়ামী লীগ নৌকার সঙ্গে বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সংঘাত বাড়ছে

নৌকার সঙ্গে বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সংঘাত বাড়ছে

0
নৌকার সঙ্গে বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সংঘাত বাড়ছে

তফসিল ঘোষণার দিন থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ শুরু হয়। আধিপত্য ও ক্ষমতা দেখানোর ওই সংঘাত এখন মনোনয়ন পাওয়া না পাওয়ার সংঘাতে পরিণত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন প্রার্থিতা চূড়ান্ত করলে এই সংঘাত আরও বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

প্রাথমিক বাছাইয়ে অনেক স্বতন্ত্র আর বিদ্রোহী প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করেছিলেন রিটার্নিং অফিসাররা। কিন্তু এখন নির্বাচন কমিশনের আপিলে তাদের অনেকেই প্রার্থিতা ফিরে পাচ্ছেন। আর তা নিয়ে মাঠের উত্তাপও বাড়ছে। সেই উত্তাপে সংঘাতও বাড়তে পারে।

তফসিল ঘোষণার দিন ১৫ নভেম্বর দেশের বিভিন্ন এলাকায় তফসিলকে স্বাগত জানাতে গিয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গ্রুপ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে ১৫ নভেম্বর রাতে তফসিলের পর আনন্দ মিছিল করতে গিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে উভয় গ্রুপের কমপক্ষে ১৬ জন আহত হন। একই দিন ঝালকাঠিতে যুবলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ছয় জন আহত হন। ওই দিন মোটর সাইকেল নিয়ে শহরের যুবলীগের দুই গ্রুপ মহড়া দিয়ে শক্তি দেখাতে গিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংঘাত লেগেই আছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বেশি প্রার্থীর আশায় স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহীদের উৎসাহিত করায় সংঘাত আরও বেড়ে যায়। কারণ বিদ্রোহী ছাড়াও অনেক স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। আওয়ামী লীগ থেকে যারা মনোনয়ন পেয়েছেন তাদের জন্য বড় চাপ হলো বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী। ৩০০ আসনে আওয়ামী লীগ থেকেই এবার ৪৪২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। আওয়ামী লীগ ২৯৮ আসনে প্রার্থী দিয়েছে। এখন ১৪ দল ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে তাদের আসন সমঝোতা হলে এই সংখ্যা কমবে। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাওয়া ৪৫-৫০ জন শেষ পর্যন্ত বঞ্চিত হতে পারেন। আর সেজন্য ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু স্বতন্ত্র আর বিদ্রোহী আতঙ্ক সবার জন্যই থেকে যাচ্ছে। বড় একটি অংশের মনোনয়নপত্র রিটার্নিং অফিসাররা বাতিল করলেও তারা আপিলে আবার ফিরে পাচ্ছেন। ফলে নতুন করে উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে।

নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের এই পর্যন্ত এইসব প্রার্থিতা নিয়ে দেশের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় বেশ কিছু সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ সোমবার (১১ ডিসেম্বর) ফরিদপুরের সালথা উপজেলায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী শাহদাব আকবর লাবু চৌধুরী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী জামাল হোসেনের সমর্থকদের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষে পাঁচ পুলিশ সদস্যসহ কমপক্ষে ২০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ভোট চাওয়া নিয়ে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষে দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করা হয়।

গত ২৭ নভেম্বর মাদারীপুরের কালকিনিতে প্রার্থিতা নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে পাঁচ জন আহত হন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুস সোবহান গেলাপ ও বিদ্রোহী প্রার্থী তাহমিনা সিদ্দিকীর সমর্থকদের মধ্যে ওই সংঘর্ষ হয়। ৩০ নভেম্বর নোয়াখালীর সেনবাগে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোরশেদ আলম এবং বিদ্রোহী প্রার্থী আতাউর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। একই দিনে ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডে নৌকার প্রার্থী তাহজীব আলম সিদ্দিকী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী নাসের শাহরিয়ার জাহেদির সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। তাদের সমর্থকদের মধ্যে এরপর ৬ ডিসেম্বরও সংঘর্ষ হয়েছে। ২ ডিসেম্বর শরীয়তপুরের নড়িয়ায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ কে এম এনামুল হক শামীম এবং স্বতন্ত্র বিদ্রোহী প্রার্থী খালেদ শওকত আলীর সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে হাত বোমার বিস্ফোরণও ঘটে। এতে উভয় পক্ষে ১০ জন আহত হন। পঞ্চগড়-১ আসনের নৌকার প্রার্থী নুরুজ্জামান ভুঁইয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হাড় ভেঙে দেয়ার হুমকি দেন ৬ ডিসেম্বর।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান ভুঁইয়ার পক্ষে কাজ করায় আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারীকে নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে ৮ ডিসেম্বর। ফরিদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম হকের লোকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদের লোজনকে মারধর করেছে বলে থানায় অভিযোগ করা হয়েছে ৯ ডিসেম্বর।

কয়েকটি এলাকায় কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা এবার হেসে খেলে পাস করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের ব্যাপারে নমনীয় অবস্থান জানানোর পর তারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যান। তাই তারা বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দমাতে চাইছেন। ফলে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে।

এদিকে সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ প্রাথমিক বাছাইয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তারা অনেক স্বতন্ত্র এবং বিদ্রোহী প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করলেও আপিলে তারা অনেকেই প্রার্থীরা ফিরে পাচ্ছেন। তাই আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের যে আশা দেখিয়েছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা সেই আশা উবে যাচ্ছে। জানা গেছে, যারা এমপি হিসেবে এবারও মনোনয়ন পেয়েছেন তাদের অনেকেরই জনপ্রিয়তায় বেশ ভাটার টান। বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্ররা তাদের ঘুম হারাম করে দিতে পারেন যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়। ফলে নৌকার প্রার্থীরা এখন স্বতন্ত্র এবং বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মরিয়া।

তবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে নানা ধরনের গ্রুপিং থাকে সেখান থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। নির্বাচন হবে নিরপেক্ষ এবং সবাই তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন।’

তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘কোনো প্রার্থী তিনি দলীয়, বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হোন না কেন নির্বাচন কমিশন সবার প্রতি সমান আচরণ করবে। সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টি করবে।’

আর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন উৎসবের মতো। যুগ যুগ ধরে নির্বাচনে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়ে আসছে। সেই তুলনায় এটা কিছুই না। পয়েন্ট জিরো থ্রি পার্সেন্ট। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি অনেক ভালো আছে। তবে আমরাও চাই সংঘাত-সংঘর্ষ যাতে একদমই না হয়।’

তার কথা, ‘প্রধানমন্ত্রী যেরকম বলেছেন সেভাবেই হবে। সব প্রার্থী সমান সুবিধা পাবেন। দলীয়, স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী প্রার্থীদের সবার প্রতি সমান আচরণ করা হবে। যারা যোগ্য, জনপ্রিয়, যাদের ভোটাররা ভোট দেবেন তারা নির্বাচনে জয়লাভ করবেন।’

আর জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ‘এবার নির্বাচনে একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের ভোটারের উপস্থিতি বাড়াতে স্বতন্ত্র, নিজ দলের বিদ্রোহী সবার জন্য প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এতে যারা শাসক দলের প্রার্থী তারা অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখে আছেন। তারা অনেকটা তাই ডেসপারেট হয়ে উঠেছেন। সামনে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।’

তিনি রিটার্নিং অফিসারদের কিছু সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেন, ‘প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষেত্রে তারা ন্যায্য আচরণ করেননি। ফলে আপিলে তাদের প্রার্থিতা আবার টিকে যাচ্ছে।’

তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য শতকরা এক ভাগ ভোটারের সমর্থন প্রথার সমালোচনা করে বলেন এতে ভোটারের গোপনীয়তা ভঙ্গ হয়। তাই এই নিয়ম বাতিলের দাবি করেন তিনি।