বাড়ি বাংলাদেশ জাতীয় শরিকদের আসন ভাগাভাগি নিয়ে শেষ মুহূর্তের দেনদরবার

শরিকদের আসন ভাগাভাগি নিয়ে শেষ মুহূর্তের দেনদরবার

1
শরীকদের আসন ভাগাভাগি নিয়ে শেষ মুহূর্তের দেনদরবার

চলছে বৈঠকের পর বৈঠক। কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো গোপনে। তালিকা চালাচালি হচ্ছে পরস্পরের মধ্যে। সেই তালিকা নিয়ে চলছে কাটাছেঁড়া। আসনের সংখ্যা নিয়েও চলছে বাহাস। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে স্বতন্ত্রদের বসানোর কৌশল। প্রতীকের চেয়ে স্বতন্ত্ররাই এখন হয়ে উঠেছেন মুখ্য বিষয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলীয় জোটের শরীকদের আসন ভাগাভাগির বর্তমান চিত্র এটি। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিন আগামী ১৭ই ডিসেম্বর। কিন্তু ১৫ই ডিসেম্বরের মধ্যেই সবকিছু চূড়ান্ত করতে চায় তিনপক্ষই।

এর মধ্যে আওয়ামী লীগ কিছুটা ধীরগতিতে এগোতে চাইলেও শরিক ও জাতীয় পার্টি দ্রুত সমাধানের দাবি জানিয়েছে। আসন ভাগাভাগি নিয়ে প্রথমে জোট শরিকদের সঙ্গে দেনদরবার চলছিল আওয়ামী লীগের। বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে টানা ৪ ঘণ্টা বৈঠক করেছে শরিক জোটের শীর্ষ নেতারা। সেখানে চূড়ান্ত সমাধান হয়নি। আওয়ামী লীগ সভাপতি ৪ সদস্যের কমিটিকে দায়িত্ব দেন শরিকদের দাবি দাওয়া নিয়ে কথা বলতে। এরই অংশ হিসেবে শরিক জোটের নেতারা পৃথকভাবে কয়েক দফা বৈঠক করেন ১৪ দলীয় জোটের মূখপাত্র আমির হোসেন আমু ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে। এ সময় কিছুটা দূরত্বে ছিল জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তারাও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির হিসাবে যোগ দেয়। বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকসহ দলটির শীর্ষ কয়েক নেতার সঙ্গে। তবে আপাতত আসন ভাগাভাগির বিষয়টি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে দুই দলই। তারা নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করছেন বলে গণমাধ্যমকে জানান। কিন্তু অন্তরালে আসন ভাগাভাগি মুখ্য বিষয় বলে জানিয়েছেন দুই দলের নেতারা। কেউ কেউ যুক্তি হিসেবে বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কৌশল হিসেবে আপাতত আসনের বিষয়টি সামনে আনা হচ্ছে না। তবে শিগগিরই এ নিয়ে সমন্বিতভাবে ঘোষণা আসতে পারে বলে তারা আভাস দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির কয়েক নেতা মানবজমিনকে জানান, প্রথম বৈঠকেই ৬০টি আসন দাবি করেন জাতীয় পার্টির নেতারা। ওই তালিকা তারা দেন আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে। কিন্তু এত আসনে নৌকা প্রতীক সরিয়ে দিতে অসম্মতি জানানো হয়। তাদেরকে বলা হয়- আসনসংখ্যা আরও কমাতে হবে। এ প্রেক্ষিতে জাতীয় পার্টির নেতারা আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে ধারণা চান কতোটা আসনে তারা নৌকা প্রতীক সরাতে রাজি আছেন। তখন ক্ষমতাসীন দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সর্বোচ্চ ২০টি আসনে ছাড় দেয়া সম্ভব। আর ১৪টি আসনে নৌকা ও লাঙ্গল দুটোই থাকবে। সেখানে যার জনপ্রিয়তা বেশি সে জিতে আসবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের এ ধরনের প্রাথমিক প্রস্তাব তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখান করা হয়। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিষয়টি নিয়ে দলীয় ফোরামে আবার আলোচনা করা হবে। তারপর আবার বৈঠকে বসতে হবে। আওয়ামী লীগ তাদের ওই প্রস্তাবে সম্মতি জানায়। তবে সবকিছু দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা চূড়ান্ত করবেন বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হয়।

দলীয় নেতারা জানান, আজ বা আগামীকাল আবারো আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন জাতীয় পার্টির শীর্ষ কয়েক নেতা। তবে ওই বৈঠক কখন, কোথায় হবে তা স্পষ্ট করেননি তারা। দুই দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকের পরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য তালিকা পাঠানো হবে আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে। সেখানেই চূড়ান্ত হবে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন ভাগাভাগির ইস্যু। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, নির্বাচনের আগে আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনাটা এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কারণ আমরা সবাই চাই দেশের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে। নির্বাচনকে সুষ্ঠু অবাধ ও উৎসবমুখর করে তুলতে। জাতীয় পার্টির তালিকার প্রেক্ষিতে তাদের বলা হয়েছে-যারা জনপ্রিয়তায় এগিয়ে ও ভোটযুদ্ধে জয়লাভ করতে পারে এমন সম্ভাবনা আছে তাদেরই কেবল ছাড় দেয়া হবে। মুখ দেখে বা দলের পদ দেখে কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় আসন ভাগাভাগির বিষয়টি এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেন ওই নেতা। বিএনপি নির্বাচনে আসলে ইস্যুটা এবার গৌন হয়ে পড়তো।

এদিকে ১৪ দলের শরিকরা আওয়ামী লীগের কাছে ২০টি আসন দাবি করেছে। একাদশ জাতীয় সংসদে ১৪ দলের শরিকদের ১০টি আসন ছিল। সংশ্লিষ্টরা জানান, একটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব আদর্শ থাকে, নিজস্ব দলীয় প্রতীক থাকে। তারা নির্বাচন কমিশনে যখন নিবন্ধিত হন তখন তারা দলীয় প্রতীক নির্ধারণ করে দেন এবং সেই প্রতীক নিয়ে তাদের নির্বাচন করার কথা। কিন্তু ১৪ দলের শরিকরা কেউই নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করতে আগ্রহী নন। তারা চান আওয়ালী লীগের প্রতীক নৌকা। নির্বাচনে তারা নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে বসিয়ে দিতে চান, ঠিক তেমনই ওই আসনে যেন আওয়ামী লীগের কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকে সেটিরও নিশ্চয়তা চান। কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, এবারের নির্বাচন হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক। জনগণের ভোটেই নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে। বসতে হবে সংসদে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটের নির্বাচনী কৌশল প্রসঙ্গে আমির হোসেন আমু বলেন, কিছু আসনে আমরা একসঙ্গে নির্বাচন করবো। আর কিছু আসনে শরিক দলগুলো নিজেদের মতো নির্বাচন করবে। একসঙ্গে নির্বাচন করা আসনগুলোয় শরিকরা নৌকা প্রতীক ব্যবহার করবে। বাকি আসনগুলোয় তাদের নিজেদের প্রতীক ব্যবহার করবে। আওয়ামী লীগ ও জোটের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আপাতত নীতিগতভাবে আওয়ামী লীগ জোটের ৪ নেতাকে আসন ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে। এ সংখ্যা হয়তো আরও দুই থেকে ৩টি বাড়তে পারে। যে ৪টি আসন শরিক ১৪ দলের জন্য ছেড়ে দিতে আওয়ামী লীগ একমত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- কুষ্টিয়া-২ আসনে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, আগে থেকেই এই আসনে কোনো প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ।

রাশেদ খান মেনন এবার বরিশাল-২ অথবা বরিশাল-৩ আসন থেকে নির্বাচন করবেন এবং যে আসনটিতে তিনি নির্বাচন করতে চান তা আওয়ামী লীগ ছেড়ে দেবে। পিরোজপুর-২ আসনটি আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জন্য ছেড়ে দেয়া হবে এবং চট্টগ্রামের একটি আসন সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর জন্য ছেড়ে দেয়া হবে। তিনি তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান। অন্যদিকে আরও দুটি আসন নিয়ে দেনদরবার চলছে জোটের নেতাদের সঙ্গে। আসন দুটি হচ্ছে- রাজশাহী-২ আসন, এখানে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী ফজলে হোসেন বাদশা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। এ ছাড়া জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারের আসন নিয়ে দেনদরবার চলছে। পাশাপাশি আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জেপির মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলামের মনোনয়ন নিয়েও দেন দরবার চলছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। এর আগে মাদারীপুর-৩ আসন হতে তিনি ২ বার জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। আগামীকাল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন আওয়ামী লীগের নেতারা। সেখানেই প্রাথমিকভাবে দেনদরবারের ইতি ঘটবে বলে আশা করছেন দুই পক্ষের নেতারা। এরপরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য পাঠানো হবে আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে।

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার মহাজোট শরিক দলগুলোকে দিয়েছিলো ৪৫টি আসন। যার মধ্যে জাতীয় পার্টিকে দেওয়া হয়েছিল ২৯টি আসন। আর বাকি ১৬টি আসন দেয়া হয়েছিলো ১৪ দলীয় জোটের শরীকদের। তাদের মধ্যে জাতীয় পার্টি ২২জন, ওয়ার্কার্স পার্টির ৫ জন, জাসদ (ইনু)-র ৩ জন, তরিকত ফেডারেশন ২ জন, যুক্তফ্রন্ট-বিকল্পধারার ৩ জন, এবং জাসদ (বাদল)-এর ১ জন প্রার্থী জয়ী হয়েছিলো।