বাড়ি প্রবন্ধ/ নিবন্ধ বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে যেভাবে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে

বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে যেভাবে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে

0
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে নিবন্ধ

গত ২০ নভেম্বর সানজিদা ইসলাম তুলি ঘুম থেকে উঠেই জানতে পারেন যে তার বড় ভাই সাজেদুল ইসলাম সুমন (দেশের প্রধান বিরোধী দল- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতা) অগ্নিসংযোগের মামলায় আড়াই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন।

অথচ, গত আট বছর ধরে তুলি এবং তুলির পরিবার সুমনকে খুঁজে বের করার জন্য সম্ভাব্য প্রতিটি দরজায় কড়া নেড়ে চলেছেন। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রায় ৬০০ জনকে “গুম” করা হয়েছে, সুমন তাদেরই একজন।

স্বাধীন গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর রিপোর্টে এ ধরনের অপহরণ এবং গোপনে আটকে রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী এবং নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ভূমিকা বিস্তারিতভাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে।

তুলি বলছিলেন, “আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে এই রায় দেখাটা আমাদের জন্য কতোটা আশ্চর্যজনক এবং দুঃখজনক, আপনাদের সেটা বুঝতে পারার কথা। কিন্তু, এতে এটাই বোঝা যায় যে আগামী নির্বাচনের আগে নিজের প্রধান রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে এই সরকার সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করেছে।”

আগামী ০৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সম্ভাব্য কারচুপি এবং একতরফা নির্বাচনের অভিযোগে তীব্র প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়ে হাসিনা এবং তার প্রশাসন বিরোধী দল ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে সহিংস দমন-পীড়ন শুরু করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) বলছে, ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগের জন্য ১০ হাজার বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

পুলিশি তৎপরতা এতোটাই অত্যাচারপূর্ণ যে সুমনের মতো জোর করে গুম হওয়া কিংবা সানাউল্লাহ মিয়ার মতো মৃত্যুবরণ করা- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। সানাউল্লাহ মিয়া ছিলেন আইনজীবী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতা। তিন বছর আগে তিনি মারা গেলেও নভেম্বরে পুলিশের একটি অগ্নিসংযোগের মামলায় তার নাম উঠেছে। তার ছেলে শফিকুর রহমান স্ক্রলকে বলেন, “পুলিশ কেবল আমার মৃত বাবাকেই অভিযুক্ত করেনি, বরং আমাদের পরিবারকেও এমন একটি অপরাধের জন্য হয়রানি করেছে যেটি কখনও ঘটেইনি।”

আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী আরাফাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ নেন। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় শান্তিপূর্ণভাবে অংশগ্রহণ না করার জন্য তিনি বরং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে অভিযুক্ত করেন৷ তার অভিযোগ, দলটি সহিংসতা এবং অগ্নিসংযোগের আশ্রয় নিচ্ছে। তিনি বলেন, “রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য তাদের জেলে পাঠানো হচ্ছে না। তাদের অপরাধের জন্যই কারাগারে পাঠানো হচ্ছে।”

আগের নির্বাচনগুলোর ছায়া

পুরনো এবং প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দল- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচনে কোনো প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া থেকে বিরত রয়েছে। ৩০ নভেম্বর ছিল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ। নির্বাচনী প্রক্রিয়া সুষ্ঠু করার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর প্রবল চাপ সত্ত্বেও, বাংলাদেশ ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত “একতরফা” নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি করতেই প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে।

২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত বিগত জাতীয় নির্বাচনে (যেটিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল অংশ নিয়েছিল) কারচুপির অভিযোগ আসন্ন নির্বাচনের উপরও ছায়া ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে যে তারা এবার কোনো বিতর্কিত নির্বাচন সহ্য করবে না৷ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার সাথে “জড়িত বা সহযোগী” হিসেবে যাদের মনে করা হবে তাদের উপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি।

গত এক মাস ধরে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং দলটির প্রধান মিত্র- বাংলাদেশ জামায়াত-ই-ইসলামী, হাসিনা সরকারের পদত্যাগের দাবিতে দেশজুড়ে ধর্মঘট ও পরিবহন অবরোধ করেছে যাতে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। হাসিনার টানা তিন মেয়াদের প্রথম মেয়াদে (২০১১ সালে) বাংলাদেশের সংসদ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে।

অনেকের জেল, কারো কারো জামিন

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ভাষায়, আওয়ামী লীগ সরকার তার রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে “সহিংস স্বৈরাচারী ক্র্যাকডাউন” শুরু করেছে। এশিয়াতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সিনিয়র গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, “সরকার কূটনৈতিক অংশীদারদের কাছে দাবি করছে যে তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কিন্তু একই সাথে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিরোধীদের দিয়ে কারাগারগুলো ভর্তি করছে।”

মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রায় সব সিনিয়র নেতা কারাগারে। মধ্য পর্যায়ের অধিকাংশ নেতাই পলাতক। গত দু সপ্তাহে ঢাকার একটি আদালত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ১৩০ জনেরও বেশি নেতাকে আড়াই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দিয়েছে।

ঢাকা-ভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলছিলেন, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী দুই বছরের বেশি কারাদন্ড পাওয়া ব্যক্তিরা সংসদ সদস্য হতে পারেন না। “একেবারে ঠিক আছে, তাই না?”

স্থানীয় গণমাধ্যম বলছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বিরোধীদলীয় কর্মীদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার করেছে। পার্টির কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সদস্যদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে পুলিশ তাদের খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হলে তারা তাদের পরিবারের সদস্যদের লাঞ্ছিত বা গ্রেপ্তার করে।

সম্প্রতি আটক হওয়া বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্যরা তাদের জামিনে মুক্তির দাবিতে গত ২৮ নভেম্বর ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন। কারাবন্দী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সিনিয়র নেতা মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস বলেন, “শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। পুলিশ নির্দোষ স্ত্রীদের আটক করেছে কারণ তাদের স্বামীরা বিএনপির কর্মী। এটা কোন্ ধরনের দেশ?”

দলের যুগ্ম মহাসচিব এবং এখনও কারাগারের বাইরে থাকা হাতেগোনা কয়েকজন সিনিয়র নেতাদের একজন রাহুল কবির রিজভী। তিনি বলছিলেন, “রাজনৈতিক বিরোধিতাকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এটা সর্বাত্মক নৃশংস ও বর্বর আক্রমণ”। রিজভী বলেন, “তারা বিশ্বাস করে যে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আমাদের আন্দোলনকে দমন করে তারা গত এক দশকের মতো অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকবে।”

অন্যান্য বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের মতো ৮১ বছর বয়সী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মহাসচিব মির্জা আলমগীরের জামিন আবেদনও গত ২২ শে নভেম্বর নাকচ করা হয়। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আদালত প্রাঙ্গণের সর্বত্র বিরাজমান।

এই সংবাদদাতা উপস্থিত ছিলেন এমন একটি পাবলিক ফোরামে বক্তৃতায় তিনি বলেন, “আমি যখনই আদালতে প্রবেশ করতে চাই তখনই আমার গাড়ি থামানো হয়৷ আমি আমার দীর্ঘ কর্মজীবনে আদালত প্রাঙ্গণে ক্যান্টনমেন্ট ধরনের এমন পরিস্থিতি কখনো দেখিনি।”

কিন্তু, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমরের মতো মামলায় জামিন সম্ভব। গত ০৩ নভেম্বর অগ্নিসংযোগের মামলায় তিনি কারাগারে বন্দী হলেও জামিন পেয়ে তিন সপ্তাহ পর তিনি জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। এর একদিন পর আওয়ামী লীগ তাকে নিজেদের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচন বর্জন করার পর থেকে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের নেতাদের টিকিট দিতে বা তাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে রাজি করানোর চেষ্টা করছে।

ঢাকা-ভিত্তিক বিশ্লেষক জাহেদ বলেন, বিচার বিভাগ যে সরকারের “রাবার স্ট্যাম্প” হয়ে গেছে সেটি প্রমাণের জন্য শাহজাহান ওমরের জামিন লাভ এবং এরপর আওয়ামী লীগের টিকিট পাওয়ার ঘটনাই যথেষ্ট।” তিনি বলছিলেন, পুরো নভেম্বর মাস জুড়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশের করা প্রায় সব মামলারই একমাত্র সাক্ষী পুলিশ নিজেই। তার মতে, “মামলাগুলো অবিশ্বাস্য এবং তাড়াহুড়ো করে সেগুলোর শুনানি করা হয়েছিল।”

বেলজিয়ামের ফ্রাই ইউনিভার্সিটি ব্রাসেলস-এর রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের ফেলো সাইমুম পারভেজ স্ক্রল-কে বলেন, বিচার বিভাগ “বিরোধী দলীয় কর্মীদের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে রায় দিচ্ছে এবং চলমান পদ্ধতিগত নিপীড়নকে ক্ষমা করছে।”

তিনি বলেন, বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং বাড়িঘর ভাঙচুরের ঘটনায় আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, আওয়ামী লীগ “বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে দূরে রাখতে সম্ভাব্য সকল বাধা” আরোপের চেষ্টা করছে।

পুলিশি অভিযান চলবে

যতদিন সহিংসতা অব্যাহত থাকবে, ততদিন অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত থাকবে জানিয়ে আওয়ামী লীগের আইনপ্রণেতা আরাফাত ডনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে হেরে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর (২০২১ সালের জানুয়ারিতে) যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটলে বিদ্রোহের ঘটনার সমান্তরাল ছবি আঁকেন।

আরাফাত বলছিলেন, “যারা ক্যাপিটল ঘেরাও করতে এবং আক্রমণ করতে গিয়েছিল তারাও আদর্শিকভাবে চালিত রাজনৈতিক কর্মী ছিল। তারা রেহাইতো পায়-ই-নি, বরং তাদের অভিযুক্ত ও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং অবশেষে তাদের সাজা হয়েছিল।”

গবেষক সাইমুম পারভেজ জানান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সহিংসতা এবং অগ্নিসংযোগের জন্য দায়ী আওয়ামী লীগের এমন দাবি “কেবল যে বিচার-বিবেচনাহীন তা-ই নয়, প্রহসনমূলকও বটে।” তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যদি সত্যিকার অর্থে চায় যে বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক এবং তারা যদি একটি বিশ্বাসযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায়, “তাহলে অবিলম্বে নতুন করে গ্রেপ্তার বন্ধ করতে হবে, সব রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দিতে হবে এবং তড়িঘড়ি করে দেওয়া সাজাগুলো পর্যালোচনা করতে হবে।”

[ঢাকা ভিত্তিক সাংবাদিক ফয়সাল মাহমুদের লেখা এই নিবন্ধ ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘স্ক্রল ডট ইন’ এ ০৬ ডিসেম্বর ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে]