বাড়ি বিশ্ব সংবাদ যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশবিরোধী সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার মারা গেছেন

যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশবিরোধী সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার মারা গেছেন

0
যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশবিরোধী সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার মারা গেছেন

মার্কিন কূটনীতিক ও বিতর্কিত নোবেল বিজয়ী হেনরি কিসিঞ্জার মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ১০০ বছর। কিসিঞ্জার অ্যাসোসিয়েটস এর বরাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স নিশ্চিত করেছে এ খবর।

জার্মানির শহর নুরেমবার্গের অদূরে জার্মান-ইহুদি মা-বাবার সন্তান হেনরি কিসিঞ্জারের জন্ম ১৯২৩ সালের ২৭ মে। নাৎসি জামার্নির শাসনামলে তাদের শিশুদের সঙ্গে জোরপূর্বক ফুটবল খেলায় অংশ নিতে চাইত না শিশু কিসিঞ্জার। সেই সঙ্গে ইহুদিদের ওপর নাৎসিদের চাপিয়ে দেয়া বিধিনিষেধের প্রতিবাদ করতেন শিশু বয়স থেকে। অনেকের কাছে নন্দিত হলেও অনেকের কাছেই তিনি আবার বেশ নিন্দিত হয়ে আছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব রাজনীতিতে শান্তির বার্তার বাহক হিসেবে পরিচিত তার হাত ধরে যুক্তরাষ্ট্র তার নেতৃত্বে ফের সর্বোচ্চ শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রভাব বলয় নিয়ে সক্রিয় হয় বিশ্বরাজনীতিতে। যদিও তার শান্তির বার্তার বাহক এই উপাধি নিয়ে বিশ্বজুড়ে রয়েছে বেশ বিতর্ক।

একজন বুদ্ধিজীবী, গবেষক ও অধ্যাপক হিসেবে জীবন শুরু করলেও কিসিঞ্জারের খ্যাতি মূলত নিন্দিত একজন কূটনীতিবিদ হিসেবে। কোনো সময় নৈতিক কূটনীতির বাহক হলেও কখনও আবার বিভিন্ন দেশে উসকে দিয়েছেন বৈপ্লবিক সংগ্রাম ও ইন্ধন দিয়েছেন সামরিক জান্তা সরকারকে।

কিসিঞ্জারের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কথাই ধরা যাক। নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে সম্ভবত এটাই সবচেয়ে বিতর্কিত ও নিন্দিত ঘোষণা। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে মিলে যে মানুষ ভিয়েতনামকে ধ্বংসে মেতে ছিলেন, তাঁকেই ১৯৭৩ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হলে বিশ্ববাসী হতবাক হয়ে যায়।

বাংলাদেশ যুদ্ধকালে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর প্রতি এই হেনরি কিসিঞ্জারের মদদ বেশ খোলামেলা ব্যাপার ছিল। এই দেশ স্বাধীন হোক, বাংলাদেশ নামে পরিচিত হোক তিনি তা কখনোই চাননি। তার সকল অপচেষ্টাকে ব্যাহত করে দিয়ে যখন বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েই গেল তখন তিনি নিজের নৈতিক পরাজয়ের শোধ নিয়েছিলেন সদ্য স্বাধীন দেশটিকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে। ১৯৭৪ সালে পিএল ৪৮০–এর গম সরবরাহ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষে আরও বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণও ছিলেন এই হেনরি কিসিঞ্জার।

এমনকি ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পেছনেও তার ইন্ধনের কথা সবার জানা। বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রে বিদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জড়িত ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেসময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই ড. হেনরি কিসিঞ্জার। মুজিব হত্যার ৫ দিনের মাথায় ২০ আগস্ট খুনি মোশতাককে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিহিংসাপরায়ণ কিসিঞ্জার এতটাই উল্লসিত হন যে, তিনি বলেন- ‘মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দিতে পেরে আমরা নিজেকে ধন্য মনে করছি।’

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিভিন্ন দলিল থেকে অকাট্য প্রমাণ মিলে যে, মোশতাক সরকারকে দ্রুত স্বীকৃতি দিতে কিসিঞ্জার সংকল্পবদ্ধ ছিলেন।

তবে হেনরি কিসিঞ্জারের এসব অপকর্ম শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁর পৌরোহিত্যকালে ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সিআইএর সহায়তায় সংঘটিত সেনা অভ্যুত্থানে চিলির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সালভাদর আলেন্দেকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল অগাস্তো পিনোশে। ১৯৭৬ সালে তাঁর ‘সবুজ সংকেত’ পেয়ে আর্জেন্টিনায় নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইসাবেল পেরনকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাবাহিনী এবং দশকব্যাপী ‘ডার্টি ওয়ার’–এর সূচনা করে। কঙ্গোর একনায়ক মবুতু সেসে সেকোকে প্রশংসা ও সমর্থন দিয়ে গেছেন কিসিঞ্জার। তালিকাটি আরও দীর্ঘ করা যায়।

১৯৭৩ সালে হেনরি কিসিঞ্জারকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়াকে তার নেয়া অভিনব কূটনীতিক কৌশলের প্রতি রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হিসেবে দেখছেন অনেকে।

নিক্সন, চৌ এন লাই ও মাও সে তুংয়ের মধ্যে ১৯৭২ সালের ঐতিহাসিক সম্মেলনের ধারাকে আরও এগিয়ে নিতে হেনরি কিসিঞ্জার চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অচল কূটনীতিক সম্পর্ককে পুনরায় চালু করেন। স্নায়ূযুদ্ধের সেই ঐতিহাসিক বিরোধিতাকে নির্মূল করে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও রাশিয়ার সঙ্গে আঁতাত করে ফেলেন। সেই একই সময়ে কিসিঞ্জার চিলিতে সামরিক অভ্যুত্থানে ইন্ধনদাতার ভূমিকাও রাখেন।

১৯৬৯ সালে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়ার পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তার উচ্চশিক্ষা তাকে নানানভাবে সহায়তা করে। সেই বছরই মধ্যস্থতার মাধ্যমে সংঘাত নিরসনে তার নেয়া শাটল ডিপ্লোম্যাসি বিশ্বরাজনীতে নিয়ে আসে সব নাটকীয় পরিবর্তন ও সূত্রপাত করে নতুন ধারার।

একই সঙ্গে আরব দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ইসরায়েলে বিপুল পরিমাণে সামরিক অস্ত্র ও গোলা সরবরাহ করেন তিনি। ওই অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য রক্ষায় এমন ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তিনি। এর পর কোন আরব দেশ ইসরায়েলে সরাসরি হামলা চালানো থেকে বিরত থাকে। এটি তার সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হলেও আরবদের কোণঠাসা করে দিতে তিনিই ভূমিকা রাখেন।

চলতি বছর ২৭ মে এক’শ বছর পূর্ণ করেন বর্ষীয়ান এই কূটনীতিক। জার্মান বংশোদ্ভুত মার্কিন এ নাগরিক বিভিন্ন সময় সেনা সদস্য, গোয়েন্দা কর্মকর্তা, হার্ভাড ছাত্র ও কূটনীতিক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

চিলির সামরিক অভ্যুত্থান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও পূর্ব তিমুর ও কম্বোডিয়ার বোমা হামলায় হেনরি কিসিঞ্জারের বিতর্কিত সম্পৃক্ততা এখনও বিশ্বরাজনীতিতে তাকে নিন্দিত ব্যক্তি হিসেবেই বিবেচনা করে।