বাড়ি সিলেট মৌলভীবাজার প্রধানমন্ত্রীর ছাড়া শুনতে নারাজ চা শ্রমিকরা

প্রধানমন্ত্রীর ছাড়া শুনতে নারাজ চা শ্রমিকরা

0
প্রধানমন্ত্রীর ছাড়া শুনতে নারাজ চা শ্রমিকরা

প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস প্রত্যাখ্যান করে মৌলভীবাজারের ৯২টি চা বাগানের অনেকটিতে এখনো আন্দোলন করছেন চা শ্রমিকরা। শ্রমিকরা বলছেন, মজুরি ৩০০ টাকা না করা পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে। গতকাল বিকাল ৪টায় মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার রেলগেট এলাকায় চা শ্রমিকরা চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেসের গতিরোধ করে। ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট অবরোধের কবলে পরে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়।ট্রেনের গতিরোধের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কুলাউড়া স্টেশন মাস্টার মো. মুহিব উদ্দিন আহমদ

এদিকে শ্রমিকদের কাজে নামানোর জন্য জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান ও পুলিশ সুপার মো. জাকারিয়া মঙ্গলবার বাগানে বাগানে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অচলাবস্থা পুরোপুরি কাটছে না। জেলার কিছু বাগানে আংশিক শ্রমিক কাজে যোগ দিলেও বেশির ভাগ বাগানে শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন করছেন।

এদিকে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে চলমান সংকট ও অচলাবস্থা নিরসনে শ্রম ও কর্মসংস্থান অধিদপ্তর উদ্যোগ নিয়েছে। কাল বিকাল ৩টায় শ্রম ভবনের সভাকক্ষে চা শ্রমিক নেতারা এক বৈঠকের আয়োজন করেছেন। এ বৈঠকে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের সভাপতিত্ব করার কথা রয়েছে। গতকাল শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল কাদের স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে জানা যায়, কালকের সভায় কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক, শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট ও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারদের সভায় উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।

গতকাল দুপুরে মৌলভীবাজার-সিলেট মহাসড়কের মুন্সিবাজারে ১ ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখেন চা শ্রমিকরা। এদিকে মৌলভীবাজার-কুলাউড়া-বড়লেখা আঞ্চলিক সড়কের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ করছেন চা শ্রমিকরা। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক দীপংকর ঘোষ বলেন, ‘মালিকপক্ষ আমাদের ১৪৫ টাকা দিতে চায়। আমরা সেটা নেব না। দরকার হলে আমরা না খেয়ে থাকব।

যতদিন আমাদের দাবি পূরণ না হয়, ততদিন আমরা চা বাগানের কাজে যোগ দেব না। ’

মৌলভীবাজার লুহাইউনি চা বাগানে আন্দোলনরত নারী চা শ্রমিক সবিতা গড়াইত বলেন, ‘আমাদের দুঃখ কেউ বোঝে না। আমরা ১২ দিন ধরে কর্মবিরতি করেছি। কিন্তু কেউ আমাদের আশ্বাস দেয়নি। আমরা এত কষ্ট করে কাজ করি কিন্তু আমাদের ন্যায্য মজুরি দেওয়া হয় না। চাল, ডাল, তেলসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ আছে। অসুখ হলে চিকিৎসা করাতে হয়। এর মধ্যে প্রতিদিনই জিনিসের দাম বেড়েছে। কিন্তু আমাদের মজুরি বাড়েনি। ’ লুহাইউনি চা চাবাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি অজিত কৈরি বলেন, পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী দেশের ১৬৬টি চা-বাগানে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট চলছে। ৩০০ টাকা মজুরি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। আন্দোলন কঠোর থেকে কঠোরতর হবে। দেশের বিভিন্ন বাগানে চা শ্রমিকরা একত্র হয়েছেন। বাগানে বাগানে সমাবেশ হবে। এ কর্মসূচিতে আমরা সড়ক অবরোধ করে রেখেছি।

শ্রম অধিদপ্তর শ্রীমঙ্গলের উপ-পরিচালক মো. নাহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি পংকজ কন্দ, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল, অর্থ সম্পাদক পরেশ কালিন্দি, বালিশিরা ভ্যালির কার্যকরী পরিষদের সভাপতি বিজয় হাজরা, সিলেট ভ্যালির কার্যকরী পরিষদের সভাপতি রাজু গোয়ালা, মনুধলই ভ্যালির কার্যকরী পরিষদের সভাপতি ধনা বাউরী, লস্করপুর ভ্যালির কার্যকরী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্র গৌড় ও লংলা ভ্যালির কার্যকরী পরিষদের সভাপতি শহীদুল ইসলামকে যথাসময়ে সভায় উপস্থিত থাকার জন্য বলা হয়েছে। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বালিশিরা ভ্যালির সভাপতি বিজয় হাজরা কালকের বৈঠকের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, তিনি আরও দু-তিনজন নেতাকে বৈঠকে রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া, কুলাউড়ার গাজীপুর, কমলগঞ্জের দেওড়াছড়া, মৃত্তিঙ্গা বাগানসহ কিছু বাগানে শ্রমিকরা কাজ করেছেন বলে জানা গেছে। কুলাউড়ার লুয়াইউনি-হলিছড়া বাগানের সামনে সিরাজনগর, মাথিউড়াসহ কয়েকটি বাগানের শ্রমিকরা ৩০০ টাকা মজুরি দাবিতে মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এ সময় চা শ্রমিকদের সঙ্গে তাদের স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অবস্থান করে।

কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মাহবুবুর রহমান খন্দকার বলেন, আগামী দুর্গাপূজার আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বসে মজুরি বৃদ্ধির বিষয়টি সমাধান করা হবে।

জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহ্সান সাংবাদিকদের জানান, জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া, শ্রম অধিদপ্তর শ্রীমঙ্গল কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. নাহিদুল ইসলাম মঙ্গলবার সকালে শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া, কালিঘাট, ফুলছড়া চা বাগানে সাধারণ শ্রমিকসহ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে কাজে যোগদান করার আহ্বান জানিয়েছেন। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে গত ৯ থেকে ১২ আগস্ট মৌলভীবাজারের ৯২টিসহ সারা দেশের ১৬৭টি চা বাগানে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করেন চা শ্রমিকরা। গত ১৩ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করেন চা শ্রমিকরা। ১৬ থেকে ২৪ আগস্ট বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে চা শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে পাঁচটি বৈঠক করেও কোনো সুরাহা হয়নি। তবে আজ ২৪ আগস্ট দুপুর থেকে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের কথা বলে ও কোন বাগানে শ্রমিকরা কাজে যোগ দেননি। এদিকে সিলেটে দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন চা শ্রমিকরা। গতকাল পঞ্চাতের বৈঠকেও অনড় ছিলেন তারা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন চা শ্রমিকরা। ১২ দিন ধরে দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে টানা কর্মবিরতি পালন করছেন সারা দেশের চা শ্রমিকরা। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গতকাল সকাল থেকে সিলেটে তাদের কর্মবিরতি পালন শুরু হয়।

গত সোমবার যেসব বাগানের শ্রমিকদের একাংশ কাজে যোগ দিয়েছিলেন, গতকাল তারাও ফের কর্মবিরতিতে যান। বিষয়টি সমাধানে দুপুরে সিলেটের ২৩ বাগানের পঞ্চায়েত কমিটি বৈঠকে বসেন। বৈঠকে চা শ্রমিকরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা দেন। এর আগে গতকাল সকাল থেকে লাক্কাতুড়া, মালনিছড়া ও তারাপুর বাগানের শ্রমিকরা ৩০০ টাকা মজুরির দাবি নিয়ে মিছিল করে লাক্কাতুড়া বাগান সংলগ্ন সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সামনের রাস্তায় জড়ো হন। তারা রাস্তার পাশে বিভিন্ন ধরনের প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানান। এ সময় সিলেটের অন্যান্য বাগানের শ্রমিকরাও কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। একপর্যায়ে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে সিলেটের ২৩টি বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির নেতারা লাক্কাতুড়ায় বৈঠকে বসেন। বৈঠকে সব শ্রমিক একযোগে কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দেন। আন্দোলনরতদের মধ্যে থেকে রিতেশ মোদি নামের এক চা শ্রমিক বলেন, ‘আমরা ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতেই আন্দোলনে নেমেছিলাম। এখন কিছুসংখ্যক শ্রমিক পিছটান দিলেও আমরা বেশির ভাগ শ্রমিক দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে আর প্রধানমন্ত্রীর কথা ছাড়া আমরা কাজে যোগ দিবো না। তাই আজকের বৈঠকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে। ’ মালনিছড়া চা বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি সুফল বাড়াইক বলেন, ‘গত ১২-১৪ দিন থেকে আমরা আন্দোলন করছি। আমরা যখন মিছিল-মিটিং করি তখন তো আমাদের কেউ দেখে না। আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে ৩০০ টাকা মজুরি না হওয়া পর্যন্ত আমরা কাজে ফিরব না। ’

রাজু গোয়ালা বলেন, ‘সব চা শ্রমিক যেহেতু একটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ৩০০ টাকা মজুরি ছাড়া তারা কাজে যোগ দেবেন না, সেহেতু আমিও তাদের সঙ্গে আছি। তারা কাজে যোগ না দিলে তো আর জোর করে কাজ করানো যাবে না। ’
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ১ টি বাগান ছাড়া সব বাগান বন্ধ ছিল। আজ ২৪ আগষ্ট দুপুরে ঢাকা সিলেট সড়ক অবরোধ করে উপজেলার লছনা নামক স্থানে। উপস্থিত হয় উপজেলা কর্মকর্তা আল রাজিব মিঠুন সহ থানা পুলিশ শ্রমিকদের অনুরোধ করেন রাস্তা ছেড়ে দিতে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সাড়ে ৫ টা ও আন্দোলন কারী শ্রমিককেরা রাস্তায় অবরোধ করে রাখেন। ২০ থেকে ৩০০ টাকায় দৈনিক মজুরি উন্নীতকরণের দাবিতে সিলেটসহ সারা দেশের চা শ্রমিকরা গত ৯ আগস্ট থেকে আন্দোলনে নামেন। ৯ থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত তারা ২ ঘণ্টা কর্মবিরতি পালনের পর গত ১৩ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি পালন করছেন। সংকট নিরসনে শ্রম অধিদপ্তরের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক হলেও সমাধান আসেনি।

২০ আগস্ট মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে বিভাগীয় শ্রম দপ্তর অফিসে মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ, শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী ও চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেণ পাল বৈঠকে বসেন। ত্রিপক্ষীয় ওই বৈঠকে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা করার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে নেতারা এ সিদ্ধান্ত মেনে এলেও শ্রমিকরা তা প্রত্যাখ্যান করে ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। ঘোষণা অনুযায়ী আন্দোলন চলছে। এক মাত্র প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কারো কথা আমাদের শুনার দরকার নেই।

বাংলা ম্যাগাজিন /এসপি