বাড়ি অপরাধ রেলপথে ৯৭ ভয়ঙ্কর স্পটে সন্ত্রাস

রেলপথে ৯৭ ভয়ঙ্কর স্পটে সন্ত্রাস

2
রেলপথে ৯৭ ভয়ঙ্কর স্পটে সন্ত্রাস

ঢাকা থেকে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জগামী কমিউটার ট্রেনের ছাদে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গত ২৩শে সেপ্টেম্বর। ডাকাতরা ট্রেনের ছাদে থাকা যাত্রীদের কাছ থেকে টাকাসহ অন্যান্য মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নিচ্ছিলো। অন্যদের কাছ থেকে খুব সহজে ছিনিয়ে নিলেও নাহিদ মিয়া ও সাগর মিয়া নামের দুই যাত্রী ডাকাতদের বাধা দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ডাকাতরা ওই দুজনকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে। পরে রুবেল মিয়া নামে আরেকজনকে ছুরিকাঘাত করে ডাকাতরা পালিয়ে যায়।

ট্রেনটি জামালপুর পৌঁছালে তিনজনকে ছাদ থেকে নামিয়ে হাসপাতালে নেয়া হলে নাহিদ ও সাগরকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। এ ঘটনায় র‌্যাব ৫ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে। র‌্যাব জানিয়েছে, এই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার কমলাপুর, বিমানবন্দর ও টঙ্গী রেলস্টেশন থেকে ডাকাতি এবং ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে ট্রেনে উঠতো।তাদের কিছু সহযোগী গফরগাঁও ফাতেমানগর স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে সম্মিলিতভাবে ডাকাতি ও ছিনতাই করে ময়মনসিংহ স্টেশনে নেমে যেত।

রেলের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে ২৪ ঘণ্টায় তিন শতাধিক এক্সপ্রেস, মেইল, লোকাল ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করছে। মোট রেলপথের সাতশ’ কিলোমিটার অরক্ষিত। ওইসব এলাকায় রাতের বেলা নির্জন থাকে। এমনকি দিনের বেলায় নানা ধরনের অপরাধ হয়। বিশেষ করে রাতের বেলায় সংঘবদ্ধ অপরাধী ও ছিনতাইকারীসহ অন্যান্য দুষ্কৃতকারী ট্রেনে হত্যার পর লাশ গুম করতে এসব অন্ধকার ও নির্জন এলাকা বেছে নেয়।  

শুধু কমিউটার ট্রেনের ওই ঘটনাই নয়। রেলপথে দীর্ঘদিন ধরে এমন কিসিমের নানা অপরাধ ঘটছে। কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না রেলপথে ঘটে যাওয়া অপরাধ। প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্নস্থানে হত্যাকাণ্ড, চুরি, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া রেলপথে নির্বিঘ্নে মাদক পরিবহনের ঘটনা ঘটছে বলেও অভিযোগ আছে। অভিযোগ রয়েছে রেলের ২ হাজার ৯৫৬ কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ৭শ’ কিলোমিটার পথই এখন অরক্ষিত। এর মধ্যে ৯৭ স্পটকে ভয়ঙ্কর স্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব স্পটে প্রতিনিয়ত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটে।

পুলিশের একটি সংস্থার অনুসন্ধানে বের হয়েছে, রেলের অরক্ষিত ৭শ’ কিলোমিটারের মধ্যে পাকশীর আব্দুলপুর, ঈশ্বরদী, রাজশাহী, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, আমনুরা, হাতিবান্ধা, পার্বতীপুর, সৈয়দপুর, ললিতনগর, সান্তাহার, কাউনিয়া, চাটমোহর, বালাসী, পোড়াদহ, কালুখালী, দৌলতদিয়া, নওয়াপাড়া, রহনপুর, দর্শনা, নাটোর, কমলাপুর, বিমানবন্দর, আখাউড়া, ভৈরব, বি.বাড়িয়া, লাকসাম, ফেনীর ফতেহপুর, খুলনা, সিলেটের ছাতক, ফেঞ্চুগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমা, কুলাউড়া, শ্রীমঙ্গল, শমসেরনগর, শায়েস্তাগঞ্জ, নতুনবাজার, টঙ্গী, কুমিল্লা, ঘোড়াশাল, লাকসাম, মীরসরাইসহ ৪১টি স্পটকে অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এসব এলাকার বেশির ভাগ স্থানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার নয়। কিছু কিছু এলাকায় নিরাপত্তা  নেই বললেই চলে। খুলনা বিভাগের ৫৬টি স্পটের মধ্যে খুলনা জেলার ১৫টি পয়েন্ট, যশোর জেলার ২৩টি পয়েন্ট, ঝিনাইদহের ১৮টি পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, মাদক ব্যবসায়ীরা নির্বিঘ্নে মাদকের চালান নিয়ে আসছে ট্রেনে করে। লাকসাম, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলাসহ সীমান্তবর্তী এলাকা হয়ে আসা যাত্রীবাহী ট্রেনগুলোতে মাদক বহন করা হয়।

চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা তুর্ণা নিশিতা, মহানগর প্রভাতী, চট্টগ্রাম মেইল, ওয়ান-আপ, সিলেট থেকে ছেড়ে আসা পারাবত, জয়ন্তিকা, উপকূল, কুশিয়ারা, বাল্লা, আখাউড়া থেকে ছেড়ে আসা ডেমু ট্রেনগুলো সীমান্ত এলাকায় যত্রতত্র স্টেশনবিহীন দাঁড়ায় বলেও অভিযোগ রয়েছে। কখনো আবার ধীরগতিতে চলে। ওই সময় বস্তায় বস্তায় মাদকদ্রব্য ট্রেনে তোলা হয়। ত্রিপুরা সীমান্ত হয়ে আসা মাদকের চালান কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ জেলা সংলগ্ন রেলপথ দিয়ে ট্রেনে তোলা হয়।

রেলওয়ের কোনো স্টেশনেই স্ক্যানিং মেশিন নেই। ফলে সন্দেহজনক যাত্রীদের তল্লাশি বা শনাক্ত করার উপায় নাই। রয়েছে জনবল সংকট। স্টেশনগুলোতে প্রবেশ ও বের হওয়ার রয়েছে একাধিক  সুযোগ। তাই সব স্টেশন থেকে নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া ওঠানামা করা যাচ্ছে। বিশেষ করে অপরাধীরা যত্রতত্র স্থান থেকে উঠছে।

রেল পুলিশ বলছে, মাত্র ২ হাজার ৪৩২ সদস্য দিয়ে সারা দেশের রেলের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন। রেলের অরক্ষিত রাস্তাগুলোতে নিরাপত্তা বাড়াতে নানা পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। কিছু কিছু স্থানে সিসি ক্যামেরা লাগানোর উদ্যোগও রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র জানিয়েছে, ২০ জেলায় পাথর নিক্ষেপের ঘটনা বেশি ঘটে। এর মধ্যে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ৫টি ও পশ্চিমাঞ্চলের ১৫টি জেলা রয়েছে। ২০ জেলার মধ্যে ৭০টি স্পটকে স্ট্রোন থ্রয়িং স্পট (পাথর নিক্ষেপ স্পট) হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। এসব স্পটে সবচেয়ে বেশি পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।

এর মধ্যে রয়েছে- গাজীপুরের টঙ্গী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে গঙ্গাসাগর, কুমিল্লার ময়নামতি, চট্টগ্রামের পাহাড়তলি, সীতাকুণ্ড, নরসিংদী, পুবাইল, গফরগাঁও, গৌরীপুর, মোহনগঞ্জ, সরিষাবাড়ী, দেওয়ানগঞ্জ, ঢাকার তেজগাঁও, কাওরানবাজার, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, লালমনিরহাট, পীরগঞ্জ, গাইবান্ধা, বুনারপাতা, সোনাতলা, আজিমনগর, খুলনা, পার্বতীপুর, জামতইল, কোটচাঁদপুর, নোয়াপাড়া, দৌলতপুর, রংপুর, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা, ষোলশহর ফৌজদারিহাট, সীতাকুণ্ড, চৌমুহনী, শশীদল, ইমামবাড়ি, কসবা, পাঘাচং, ভাতশালা, শায়েস্তাগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কাউনিয়া ও বামনডাঙ্গা। এর বাইরে আরও অনেক স্পট আছে মাঝে মধ্যে ওই স্পট থেকে পাথর নিক্ষেপ করা হয়।

রেলওয়ে পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক দিদার আহম্মেদ বলেন, ট্রেনের পাথর নিক্ষেপের ঘটনা রোধে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে আমরা প্রতিনিয়ত বৈঠক করছি। আমরা মানুষকে বুঝানোর চেষ্টা করছি তাদের জন্য যেটা খেলা সেটি আরেকজনের মৃত্যুর কারণ। এরপরেও যারা কথা শুনছে না তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

ডাকাতির মতো ঘটনাও ঘটেছে। তবে এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, রেলপথে যেকোনো ধরনের অপরাধের বিষয়ে পুলিশ জিরো টলারেন্স নীতিতে চলছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। অপরাধপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।