বাড়ি এক্সক্লুসিভ দেশীমাছের পেটে পাওয়া গেছে ক্ষতিকর প্লাস্টিক কণা

দেশীমাছের পেটে পাওয়া গেছে ক্ষতিকর প্লাস্টিক কণা

0
দেশীমাছের পেটে পাওয়া গেছে ক্ষতিকর প্লাস্টিক কণা

মাছে ভাতে বাঙালি- একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ। মাছ ছাড়া যেন আমাদের এক বেলার আহারও হয় না। কিন্তু এই মাছ নিয়েই একটি দুঃসংবাদ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে ৭৩ শতাংশ মাছে রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক বা প্লাস্টিকের কণা, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠতে পারে।দেশি মাছের ওপর এই গবেষণাটি চালিয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ। বাজারে পাওয়া যায় এমন দেশি মাছের ওপর গবেষণা করে জানা যায়, ১৫ প্রজাতির মাছে প্লাস্টিকের এই ক্ষুদ্র কণার উপস্থিতি রয়েছে।

সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থী সুমাইয়া জান্নাত থিসিসের জন্য এ গবেষণাটি পরিচালনা করেন। এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন বিভাগের অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক ও সহযোগী অধ্যাপক ফাহমিদা পারভিন।যেসব প্লাস্টিক পলিমার পাওয়া গেছে তার মধ্যে রয়েছে- হাই ডেনসিটি পলিথিলিন, পলিপ্রোপাইলিন-পলিথিলিন কপোলাইমার এবং ইথিলিন ভিনাইল এসিটেট।

সুমাইয়া জান্নাত বলেন, “স্নাতকোত্তরের থিসিসের কাজে ১৮ প্রজাতির দেশি মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব নিয়ে অনুসন্ধান করি। এসব মাছের মধ্যে ১৫ প্রজাতির পরিপাকতন্ত্রে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। মাছগুলো সাধারণত কৃত্রিম উপায়ে মিষ্টি পানির জলাধারে চাষ করা হয়। পরীক্ষা করা মাছগুলোর ৭৩.৩%-এ প্লাস্টিকের কণা পাওয়া গেছে। গবেষণার মাছগুলো সাভার ও আশুলিয়া বাজার থেকে সংগ্রহ করা হয়।”

যেসব মাছের পেটে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে তার মধ্যে রয়েছে রুই, তেলাপিয়া, কই, কালিবাউশ, বেলে, টেংরা, কমন কার্প, পাবদা, পুঁটি, শিং, টাটকিনি, বাইন, বাটা, মেনি ও বাছা। তার মধ্যে টেংরা, টাটকিনি ও মেনি মাছে বেশি পরিমাণে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে।ঢাকার কাছে সাভার ও আশুলিয়ার দুটি স্থানীয় বাজার থেকে এসব মাছ কেনা হয়েছে যা দেশের নদী নালা, খাল বিল, পুকুর ও জলাশয়ের স্বাদু পানিতে পাওয়া যায়।

মাছে প্লাস্টিক পলিমার হাই ডেনসিটি পলিথিলিন, পলিপ্রপিলিন পলিথিলিন কপোলিমার ও ইথিলিন ভিনাইল এসিটেটের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে। এসব প্লাস্টিক পলিমার দৈনন্দিন ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বিভিন্ন বোতল, প্লাস্টিকের ব্যাগ, কনটেইনার, প্লাস্টিক ও ফোমের জুতা এবং মোড়ক ইত্যাদি থেকে পরিবেশে প্রবেশ করে।গবেষণায় আরও জানা যায়, মাছের পেটে উপস্থিত প্লাস্টিক কণা সরাসরি খাদ্যের সঙ্গে মানুষের দেহে প্রবেশ করে না। তবে এগুলো থেকে নিঃসৃত বিষাক্ত রাসায়নিক মাছের দেহে জমা হয়। পরে এসব মাছ খাবার হিসেবে গ্রহণ করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়।

মাইক্রোপ্লাস্টিক হচ্ছে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা। আকারে এটি সর্বোচ্চ পাঁচ মিলিমিটার পর্যন্ত বড় হতে পারে।বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য পানিতে ফেলে দিলে সেসব ফটোকেমিক্যালি ও বায়োলজিক্যালি ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়।“এছাড়াও আমরা বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্য ব্যবহার করি, যেমন টুথপেস্ট, ফেসওয়াশ, যেগুলোতে ছোট ছোট বীজ থাকে। এগুলো আসলে মাইক্রোপ্লাস্টিক বা প্লাস্টিকের বীজ। এগুলো পানিতে চলে যায় এবং মাছ এগুলোকে খাবারের সাথে ভুল করে খেয়ে ফেলে। এভাবে মাছের শরীরে প্লাস্টিকটা চলে যায়,” বলেন অধ্যাপক পারভীন।

তিনি আরো বলেন, “দেশের ১৮ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৫ প্রজাতির মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি দেখা গেছে। বাকি তিন প্রজাতি ফলি, শিং ও গুলশা মাছে প্লাস্টিকের কণা পাওয়া যায়নি। যেসব মাছ পানির সবচেয়ে নিচের স্তরে বাস করে, তাদের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি বেশি। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক মানবদেহের জন্য ক্ষতিকার।” 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় মাছের পরিপাকতন্ত্রে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেলেও বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাছের দেহেও এসব প্লাস্টিক চলে আসার প্রমাণ পাওয়া গেছে।ফাহমিদা পারভীন বলছেন, “বাইরের আরো অনেক দেশে উন্নত ধরনের কিছু গবেষণা হয়েছে যাতে দেখা গেছে যে মাছের পেশী, চামড়া, মাংস ও লিভারেও প্লাস্টিক রয়েছে।”অর্থাৎ মাছ খেলে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা মানুষের দেহেও চলে আসবে।

বাংলাদেশে পলিথিনের যেসব ব্যাগ ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে প্লাস্টিকের পলিমার ছাড়াও থাকে নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ – বিসফেনল-এ, থেলেট, থেলেট এস্টার, পলিভিনাইল ক্লোরাইড ইত্যাদি। প্লাস্টিককে নমনীয় করার জন্য এসব যোগ করা হয়।এসব বিষাক্ত পদার্থ মানুষের জন্য ক্ষতিকর।“প্লাস্টিকের কণা যদি মানুষের শরীরে না-ও যায়, ওই প্লাস্টিক থেকে যেসব বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হচ্ছে, সেগুলো মাছের দেহে জমা হয়। এসব বিষাক্ত রাসায়নিক মানুষের শরীরে যাচ্ছে এবং এর ফলে স্তন ক্যান্সারসহ নানা ধরনের অসুখ হতে পারে,” বলেন গবেষক ফাহমিদা পারভীন।