বাড়ি এক্সক্লুসিভ সরকারি সুবিধাদি নেয়া ও মন্ত্রণালয়ের খরচে বিদেশ ভ্রমণকেই টার্গেট হিসেবে নিয়েছে এমপিরা

সরকারি সুবিধাদি নেয়া ও মন্ত্রণালয়ের খরচে বিদেশ ভ্রমণকেই টার্গেট হিসেবে নিয়েছে এমপিরা

0
সরকারি সুবিধাদি নেয়া এবং মন্ত্রণালয়ের খরচে বিদেশ ভ্রমণকেই টার্গেট হিসেবে নিয়েছে এমপিরা

মন্ত্রণালয়ের কাজ পর্যালোচনা, অনিয়ম ও গুরুতর অভিযোগ তদন্ত করাই হচ্ছে জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলোর অন্যতম প্রধান কাজ। এছাড়া বিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেয়া বা সুপারিশ করাও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। চলমান একাদশ জাতীয় সংসদে মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত ৩৯টি এবং বিষয় বা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ১১টি স্থায়ী কমিটি আছে। এসব কমিটির অধিকাংশই কেবলই ‘ওয়াচ ডগ’ হিসেবে রয়েছে। নিয়মিত বৈঠক করা তো হচ্ছেই না উল্টো কমিটি প্রধান এবং সদস্য এমপিরা সরকারি সুবিধাদি নেয়া এবং মন্ত্রণালয়ের খরচে বিদেশ ভ্রমণকেই টার্গেট হিসেবে নিয়েছেন বলে নানা অভিযোগ রয়েছে।

এমপিরা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করেন কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগান না। অবশ্য কমিটির সংশ্লিষ্টরা এসব বিষয় অস্বীকার করছেন। তারা বলেন, কমিটি সব সময়ই কাজ করে যাচ্ছে। তবে বৈঠক কম হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করলেও নিজস্ব সুবিধাদি নেয়ার বিষয়টিকে অনুমাননির্ভর অভিযোগ বলে দাবি করেছেন তারা।

সংসদের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একাদশ জাতীয় সংসদের শুরু থেকেই একাধিক সংসদীয় কমিটি বিদেশে সফর আয়োজনের জন্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, ইতালি ও জার্মানিতে শিক্ষাসফর আয়োজনের সুপারিশ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। সুবিধাজনক সময়ে এই সফরের আয়োজন করা হবে। প্রতিবেশী দেশের সমাজকল্যাণ কার্যক্রম দেখার জন্য বিদেশ সফরের আয়োজন করার সুপারিশ করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে এই সফরের বাজেট সংস্থান করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে নথি পাঠানো হয়েছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি তাদের প্রথম বৈঠকেই সুপারিশ করে মন্ত্রণালয় আয়োজিত যেকোনো বিদেশ সফরে কমিটির সদস্যদের পর্যায়ক্রমে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের দেশগুলোর প্রাথমিক শিক্ষাকাঠামো সরেজমিন পরিদর্শন করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চায়। এ জন্য তারা মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে বিভিন্ন দেশের প্রশাসনিক সংস্কার ও উন্নয়নকাঠামো সরেজমিন পরিদর্শন কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলে। এ জন্য প্রয়োজনে চলমান উন্নয়ন প্রকল্প সংশোধন করে এ প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করারও পরামর্শ দিয়েছে কমিটি। রোহিঙ্গাদের ফেরাতে ক‚টনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি চাপ সৃষ্টি করতে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে সফরের ব্যবস্থা করতে মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।

অবশ্য রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা করতে গত বছরের ২৩ থেকে ২৬ অক্টোবর সিঙ্গাপুর এবং ২৭ থেকে ৩০ অক্টোবর থাইল্যান্ড ভ্রমণ করেছেন কমিটির সদস্যরা। কমিটির সভাপতি ফারুক খান, সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ ও কাজী নাবিল আহমেদ ভ্রমণ করেন। ফিরে এসে তারা কমিটিতে একটি প্রতিবেদনও দিয়েছেন। তাতে বলা হয়, আসিয়ান সম্মেলনের আগে এই সফর রোহিঙ্গা ইস্যুতে খুবই সময়োচিত এবং সফল হয়েছে।

ধর্ম মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি গত বছরের ১০ জুনের বৈঠকে পবিত্র হজ, চাঁদ দেখা, মন্দির-শ্মশান সংস্কারের মতো মন্ত্রণালয়ের কাজগুলোয় নিজেদের সম্পৃক্ত করতে বলেছিল। বিশেষ করে হজ কার্যক্রমে কমিটিকে সম্পৃক্ত না করায় অনেকে ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেন। পরবর্তী সময়ে সংসদীয় কমিটির দুজন সদস্যকে সরকারি হজ প্রতিনিধিদলে রাখা হয়। এ ছাড়া কমিটির ৯ সদস্যের প্রত্যেককে রাষ্ট্রীয় খরচে হজে পাঠানোর সুযোগ করে দেয় মন্ত্রণালয়। তবে মন্ত্রণালয় বলেছে, ভবিষ্যতে প্রকল্প প্রণয়নে মন্দির, শ্মশান, আশ্রম তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে এমপিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

সর্বশেষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গত মাসের (অক্টোবর) শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিশ্বের ১০টি দেশের ১৫টি মিশন পরিদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করে। দেশ ও মিশনগুলো হলো- যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস, নিউইয়র্কে কনস্যুলেট জেনারেল ও জাতিসংঘ মিশন, সৌদি আরবের রিয়াদে দূতাবাস ও জেদ্দায় কনস্যুলেট জেনারেল, সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি ও দুবাই, লন্ডন ও বার্মিংহাম, কানাডার অটোয়া, ইতালির রোম, কাতারের দোহা ও কুয়েত সিটির বাংলাদেশ দূতাবাস এবং কুয়ালালামপুর ও সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশন। সফরের উদ্দেশ্য ওইসব দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত সংস্থাগুলোর কার্যক্রম আরো গতিশীল ও কার্যকর করার উপায় নির্ধারণের বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভ করা। বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সুবিধাজনক সময়ে মিশনগুলো পরিদর্শনের সূচি প্রণয়ন করা হবে।

এ বিষয়ে কোনো কমিটি প্রধানই গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে রাজী হননি। তবে এমপিদের বিদেশ সফর প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, এমপিদের বিদেশ সফর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভিন্ন কারণে এমপিরা বিদেশ সফর করেন। অভিজ্ঞতা বিনিয়ম ও অর্জন এর একটি অংশ। বিদেশ সফরের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিরা যেমন অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তেমনি ওই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশের মানুষও উপকৃত হন। দেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায়।

এদিকে সরকারি সুবিধাদি নেয়ার ক্ষেত্রেও রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে সংসদীয় কমিটিগুলোর মধ্যে। অনেকে আবার একেবারে ব্যক্তিগত বিষয়ও সংসদীয় কমিটির বৈঠকের আলোচনায় এনেছেন। কার্যবিবরণী থেকে দেখা যায়, গত ৭ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কমিটির সদস্য নাদিরা সুলতানা বলেন, মধুমতি টাইলস ফ্যাক্টরিটি তার প্রয়াত স্বামী প্রতিষ্ঠা করেন। এখন তিনি সেটি চালাচ্ছেন।

তিনি টাইলস আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করে বলেন, এতে রাজস্ব আয় বাড়বে আবার দেশি কারখানাগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য জিলুল হাকিম। তার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তার নামে বরাদ্দ করা জমি বেদখল এবং পূর্বাচল প্রকল্পে তার ছেলের কিস্তির টাকা পরিশোধ করার পরও প্লট বুঝিয়ে না দেয়া বা টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে সংসদীয় কমিটি। গত বছর আগস্টে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্যদের জন্য বিশেষ প্রকল্প বরাদ্দ দিতে সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদে চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়। ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি দ্বিতীয় বৈঠকে সুপারিশ করে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের অনুকূলে বিশেষ বরাদ্দ দেয়ার জন্য। পরে মন্ত্রণালয় জানায়, কমিটির সদস্যদের বিশেষ বরাদ্দ প্রদানের কার্যক্রম নেয়া হয়েছে। এভাবে নানা ধরনের সরকারি সুবিধা নিতে তৎপর থাকেন কমিটিপ্রধান ও সদস্যরা।

সংসদ বিষয়ের গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিজাম উদ্দীন আহমেদ বলেন, সংসদীয় কমিটি যদি মন্ত্রণালয় থেকে সুবিধা নেয়, ব্যক্তিগত বিষয়ে আলোচনা করে বা মন্ত্রণালয়ের খরচে বিদেশ যাওয়ার সুপারিশ করে, তাহলে মন্ত্রণালয়কে জবাবদিহি করার নৈতিক জায়গা থাকে না। মন্ত্রণালয় থেকে খরচ না নিয়ে কমিটির বিদেশ সফরের জন্য সংসদ সচিবালয় থেকে আলাদা বাজেট করা যায় বলেও মত দেন তিনি।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, জাতীয় সংসদের ক্ষমতায়নে ইউএসএইড, এশিয়া ফাউন্ডেশন, ইউএনডিপির কতগুলো প্রকল্প ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, সংসদ ও সংসদের ক্ষমতা বাড়ানো। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, অতিরিক্ত বিদেশ ভ্রমণ ও দুর্নীতির কারণে সবগুলো প্রকল্প বাতিল হয়েছে। এমপিরা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করেন কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগান না। এত বিদেশ সফর করেও তাদের সক্ষমতা বেড়েছে কি না- এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। কারণ এর কোনো প্রতিফলনই দেখা যায় না।