অর্থ ও বাণিজ্য

ঈদের রমরমা বাজারে জাল টাকা আতঙ্ক!

সক্রিয় হয়ে উঠেছে জাল টাকার কারবারিরা। এ চক্রের সদস্যরা আসন্ন ঈদের কেনাকাটায় দেশের বিভিন্ন মার্কেটে সিন্ডিকেট করে জাল টাকা বিতরণ করছে। এক্ষেত্রে এক লাখ টাকার জাল নোট বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকায়। ছড়িয়ে পড়া এসব জাল টাকার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতা-বিক্রেতারা। তাদের মাঝে দেখা দিচ্ছে এক ধরনের আতঙ্ক।

এমন পরিস্থিতিতে এ চক্রের তৎপরতা রুখতে সক্রিয় রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। এরই মাঝে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিপুল পরিমাণ জাল টাকা ও জাল টাকা তৈরির সরঞ্জামসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন চক্রের সদস্যরা। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে আরও অন্তত এক ডজন কারবারির নাম। ওইসব সদস্যরাও রয়েছেন নজরদারিতে। যে কোনো সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ জোনের ডিসি (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মশিউর রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, দেশের কোনো ধরনের উৎসব শুরুর আগে সক্রিয় হয়ে ওঠে জাল টাকার কারবারিরা। এ চক্রের সদস্যদের প্রায়ই গ্রেপ্তার করা হয়। তারপরও তারা জামিনে বেরিয়ে ফের একই অপকর্মে লিপ্ত হয়। চক্রের সদস্যরা তিনভাগে বিভক্ত থাকেন। একটি চক্র টাকা তৈরি করে। অপর চক্রটি পাইকারি হারে টাকা কিনে নিয়ে যায়। সর্বশেষ চক্রের সদস্যরা তা মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে দেন। এভাবে হাত ঘুরলেই লাখে ১৫ হাজার করে লাভ করে থাকে চক্রের সদস্যরা।

তিনি বলেন, এবার ঈদের আগেও চক্রের সদস্যরা সক্রিয় রয়েছে। এক্ষেত্রে পুলিশও বসে নেই। তাদের শনাক্ত করে গোয়েন্দা জালে নেয়া হয়েছে। যে কোনো সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।

জানা গেছে, জাল টাকা তৈরির পর সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে চক্রের সদস্যরা। প্রিন্টার ও অন্যান্য সরঞ্জামের সহায়তায় বিশেষ ধরনের কাগজে নিখুঁতভাবে জাল টাকা তৈরি করছে চক্রের সদস্যরা। এমনকি আসল টাকায় যে রং পরিবর্তনশীল কালি, অসমতল ছাপা, নিরাপত্তা সুতা ও জলছাপ রয়েছে একইভাবে বিশেষ পদ্ধতিতে জাল টাকায়ও জলছাপ ও নিরাপত্তা সুতার ব্যবহার এবং অনেক ক্ষেত্রে অসমতল ছাপাও দেয়া হচ্ছে।

এসব জাল টাকা সহসাই যে কারও পক্ষে চেনা কঠিন। জাল টাকা ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন ধাপে কাজ করে চক্রের সদস্যরা। তারা শুধু টাকাই নয় বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রাও তৈরি করছে। এরা বিভিন্ন সময় জাল টাকা ও তৈরির সরঞ্জামসহ গ্রেপ্তার হলেও জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের একই কাজ শুরু করেছে।

সূত্রমতে, ঈদ ছাড়াও অন্য ধর্মাবলম্বীদের উৎসবমুখর ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের আগে মার্কেটে কেনাকাটার সময় তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বিক্রেতাদের এসব জাল মুদ্রা গছিয়ে দেয়া হয়। প্রতিটি উৎসবের আগমুহূর্তে জাল নোট তৈরির চক্রগুলোর জাল টাকা নিখুঁত করার ব্যাপারে প্রতিযোগিতা চলে। কারণ যে চক্রের টাকা যত নিখুঁত, তার টাকার দাম তত বেশি, বিক্রিও বেশি। প্রতি ১০০ পিস ১০০০ টাকার নোট অর্থাৎ এক লাখ টাকা তৈরিতে তাদের খরচ ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা।

সেই টাকা তারা পাইকারি বিক্রেতার কাছে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। পাইকারি বিক্রেতা প্রথম খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা, প্রথম খুচরা বিক্রেতা দ্বিতীয় খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় এবং দ্বিতীয় খুচরা বিক্রেতা মাঠপর্যায়ে সেই টাকা আসল এক লাখ টাকায় বিক্রি করছে।

সূত্রমতে, মাঠপর্যায়ে কর্মীরা বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার মাধ্যমে এই জাল নোট বাজারে ছড়িয়ে থাকে। জাল টাকা তৈরি থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত কয়েকটি ভাগে তারা এ কাজ করে থাকে। প্রথমে অর্ডার অনুযায়ী জাল নোট তৈরি, দ্বিতীয় পর্যায়ে এ টাকাগুলো যে অর্ডার দেয় তার কাছে পৌঁছে দেয়া, তৃতীয় পর্যায়ে জাল টাকা বাজারে ছড়িয়ে দেয়া হয়। সারা বছর মাদকের লেনদেন, চোরাই পণ্যের কারবার, স্বর্ণ বেচাকেনাসহ বিভিন্ন অবৈধ লেনদেনে জাল নোট চালিয়ে দেয় চক্রের সদস্যরা। অন্য পেশায় থাকলেও বেশি লাভের আশায় অনেকে এ পেশায় জড়িয়ে পড়ছে।

জানা গেছে, গত বুধবার রাতে শরীয়তপুরের নড়িয়া থানার চরমোহনপুর এলাকা থেকে জাল টাকা তৈরি চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব-৩ এর সদস্যরা। তারা হলেন- আরিফ ব্যাপারী, মো. জাহিদ ও অনীক। তাদের কাছ থেকে ২০ লাখ ৪৬ হাজার টাকা মূল্যমানের জাল নোট ও জাল নোট তৈরিতে ব্যবহূত সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়। চক্রের মূলহোতা আরিফ ইউটিউব থেকে জাল টাকা বানানোর প্রক্রিয়া দেখে রপ্ত করে দুই সহযোগী নিয়ে নিজের ঘরে বসেই তৈরি করত জাল নোট।

র‍্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, পবিত্র রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু জাল নোট প্রস্তুতকারী চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে আমরা জানতে পারি। এরই ধারাবাহিকতায় ওই তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। চক্রটি বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে জাল নোট বিক্রির নেটওয়ার্ক তৈরি করে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করত। চক্রটি প্রতি ১ লাখ টাকা মূল্যমানের জাল নোট ১২-১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করত। চক্রটি কম্পিউটার, প্রিন্টার এবং জাল টাকা তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করে ঘরে বসে জাল টাকা ছাপানোর কাজ শুরু করে।

শুধু তাই নয়, চক্রটি বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে জাল টাকা বিক্রির জন্য নেটওয়ার্ক তৈরি করে। তারা এসব পেজ প্রমোট ও বুস্টিং করে অনেক পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা সংগ্রহ করে। চক্রটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, শরীয়তপুর ও ফরিদপুর এলাকায় জাল নোট সরবরাহ করত। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীতে ৮৩ হাজার টাকা মূল্যমানের জাল নোটসহ মোহাম্মদ ফয়েজ আহমেদ রাসেলকে গ্রেপ্তার করে বাড্ডা থানা পুলিশ। তিনি জাল নোট তৈরি এ চক্রের মূলহোতা।

এ চক্রে অনেক নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী রয়েছে। তারা মাদকসহ জাল নোট কারবারের সঙ্গে জড়িত। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাসেল জানিয়েছে, ঈদে মার্কেটগুলো বেচাকেনার জন্য সরগরম হয়ে ওঠে। এ সুযোগে জাল নোটগুলো বিভিন্ন মার্কেটে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে জাল টাকা প্রতিরোধ টিম রয়েছে। তারা সর্বদা মাঠে সক্রিয় থাকে। ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে জাল টাকা কারবারিরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি থাকে। জাল টাকা, জাল টাকার সরঞ্জামসহ তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

জাল টাকা কারবারিদের প্রতিরোধে এবং কোনোভাবেই যেন জাল টাকা বাজারে ছড়িয়ে না পড়ে সে বিষয়ে পুলিশ সর্বদা তৎপর থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, তারা কেবল জাল টাকা শনাক্ত করতে পারেন, আর সেটা হাতে এলে বাতিল করতে পারেন। কারণ তাদের পক্ষে সরাসরি জড়িতদের ধরা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বদা ভূমিকা রাখছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বদা তাদের সহযোগিতা করে থাকেন।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, যারা জাল টাকা বাজারে ছাড়ে তারা একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এরা জাল নোট বাজারে ছড়িয়ে দেয়ার কারণে অর্থনৈতিক খাত ধ্বংস হচ্ছে। এদের ধরার জন্য অতিরিক্ত গোয়েন্দা নজরদারি রাখলেই এ চক্রের হাত থেকে সাধারণ মানুষ কিছুটা রক্ষা পেতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button