বিশ্ব সংবাদ

বিবিসির বিশ্লেষণ: ৩ মিত্রদেশে কেন হামলা চালাল ইরান?

সিরিয়া, ইরাক ও পাকিস্তান—তিনটি দেশই ইরানের মিত্র হিসেবে পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ে তিন দেশে বিমান হামলা চালিয়েছে তেহরান। অন্য কোনো দেশ উচ্চবাচ্য না করলেও হামলার জেরে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে পাকিস্তান। ইরানের ভূখণ্ডে পাল্টা হামলা করে বসেছে দেশটি। কিন্তু কথা হলো, ইরান কেন তিন মিত্রদেশে হামলা চালাল? কেনই–বা এই সময়ে এসব হামলা চালিয়েছে ইরান?

বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, ইরানের সামরিক বাহিনী, বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী (রেভল্যুশনারি গার্ড) দেশের অভ্যন্তরে ইসলামি রক্ষণশীলদের কাছ থেকে বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী হাজারো মানুষকে হত্যা করেছে। কিন্তু এরপরও তেহরান যথেষ্ট কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেনি বলে মনে করছেন ইরানি ইসলামপন্থীরা। এই নিয়ে তাঁদের মধ্যে গোস্‌সা বাড়ছে। আর সেই চাপ গিয়ে পড়েছে ইরানি বাহিনীর ওপর।

ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী বুঝতে পারছিল, তাদের কিছু একটা করতেই হবে। কিন্তু যেটাই করা হোক না কেন, তা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি উত্তেজনা এড়িয়ে। কেননা, ইসরায়েল–ফিলিস্তিনের চলমান সংঘাতে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়া থেকে সচেতনভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে ইরান।

ইরানে ইসলামপন্থীদের অসন্তোষের আরও কয়েকটি কারণ রয়েছে। সেটি হলো সিরিয়ায় ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বিপ্লবী রক্ষী বাহিনীর কয়েকজন কমান্ডারকে হত্যার পরও কিছুই করতে না পারা। সাম্প্রতিক সময়ে ইঙ্গ–মার্কিন হামলার শিকার হওয়ার পরও ইয়েমেনের মিত্র হুতিদের শুধু মৌখিক সমর্থন জুগিয়ে যাওয়া। হুতিদের জন্য কার্যত কিছুই করতে পারছে না তারা।

এ ছাড়া সপ্তাহ দুয়েক আগে ইরানের কেরমান শহরে ভয়াবহ বোমা হামলা হয়। এতে প্রাণ যায় অন্তত ৮৪ জনের। এই হামলার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। প্রাণঘাতী এই হামলার পরও আইএসের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি ইরান। এটা অসন্তুষ্ট করেছে দেশটির ইসলামপন্থীদের।

এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী বুঝতে পারছিল, তাদের কিছু একটা করতেই হবে। কিন্তু যেটাই করা হোক না কেন, তা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি উত্তেজনা এড়িয়ে। কেননা, ইসরায়েল–ফিলিস্তিনের চলমান সংঘাতে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়া থেকে সচেতনভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে ইরান।

যদিও ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ আর ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সমর্থন ও সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে তেহরান, এমন দাবি পশ্চিমাদের। এই পরিস্থিতিতে তিন মিত্রদেশ ইরাক, সিরিয়া ও পাকিস্তানে সম্প্রতি হামলা চালিয়েছে ইরান। এর পেছনে তেহরানের বেশ কিছু নিজস্ব লক্ষ্যও রয়েছে।

ইরান জানিয়েছে, পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহার করে হামলা চালানো হয়েছে জঙ্গিগোষ্ঠী জয়েশ আল–আদলির ঘাঁটিতে। তেহরানের কাছে তারা ‘ইরানি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’। তবে পাকিস্তান বলেছে, ইরানের হামলায় নিহত দুজনই শিশু।

পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ একটি দেশ। ইরানের হামলাকে ‘সার্বভৌমত্বের স্পষ্ট লঙ্ঘন ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি আঘাত’ হিসেবে দেখছে ইসলামাবাদ। পাকিস্তানের মতে, এই হামলার মধ্য দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ দেশটির নমনীয়তাকে খাটো করে দেখা হয়েছে।

কড়া প্রতিক্রিয়া জানাতে দেরি করেনি ইসলামাবাদ। পাকিস্তানে নিযুক্ত ইরানি কূটনীতিককে বহিষ্কারের পাশাপাশি দ্রুত ইরানের ভূখণ্ডে পাল্টা হামলা চালিয়ে জবাব দিয়েছে পাকিস্তানি বাহিনী। পাকিস্তান জানিয়েছে, পাকিস্তানভিত্তিক ‘সন্ত্রাসীদের’ ওপর (বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি ও বেলুচিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট) হামলা করা হয়েছে। যদিও হামলায় তিনজন নারী, দুজন পুরুষ ও চার শিশুর মৃত্যুর খবর দিয়েছে তেহরান।

হঠাৎ এমন পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকা দুই প্রতিবেশীর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, এতে সন্দেহ নেই। মনে করা হচ্ছে, ইসলামাবাদ দ্রুততার সঙ্গে এত কড়া জবাব দেবে, সেটা আগে থেকে অনুধাবন করতে পারেনি ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী।

ধারণা করা হচ্ছে, শুধু সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সঙ্গে পরামর্শের পর তিন মিত্রদেশে হামলা চালিয়েছে ইরানের বিপ্লবী বাহিনী। এমনকি হামলার আগে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদুল্লাহিয়ানের পরামর্শ নেওয়া হয়নি, এমনও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে ৯০০ কিলোমিটারের (৫৬০ মাইল) সীমান্ত রয়েছে। সেখানকার ভূরাজনৈতিক ও ভৌগোলিক পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে পারস্পরিক সহাযোগিতা ছাড়া সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা কঠিন। আন্তর্জাতিক পরিসরে ইরান ও পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন বিষয়ে ভোটাভুটিতে তেহরানের পক্ষে অবস্থান নেয় ইসলামাবাদ।

অন্যদিকে মনে করা হচ্ছে, কেরমান শহরে আইএসের সাম্প্রতিক প্রাণঘাতী হামলার জবাবে সিরিয়ায় পাল্টা হামলা চালিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইরান। কিন্তু সিরিয়ার ভূখণ্ডে আইএসের বড় কোনো স্থাপনায় ইরানের হামলার সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেনি।

ইরানের আরেক প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরাক। দেশটির কুর্দিস্তান অঞ্চলের ইরবিলে প্রায় ১১টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে হামলা চালিয়েছে ইরান। তেহরানের দাবি, ইরাকের কুর্দিস্তানে ইসরায়েলি গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদের আস্তানা ছিল, তা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

যদিও ইরাক সরকার ও কুর্দিস্তানের আঞ্চলিক প্রশাসন জানিয়েছে, সেখানকার খ্যাতনামা একজন ব্যবসায়ীর বাড়িতে হামলা চালিয়েছে ইরান। হামলায় ওই ব্যবসায়ী, তাঁর স্ত্রী, দুই সন্তানের প্রাণ গেছে। নিহত দুই শিশুর মধ্যে একজনের বয়স এক বছরের কম।

হামলার পর ইরাক সরকার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তেহরানের বিরুদ্ধে নালিশ করেছে। এই বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু হামলার জেরে অনেক বছরের মিত্র ও প্রতিবেশী দেশ দুটির সম্পর্ক বেশ শীতল হয়ে উঠেছে।

ধারণা করা হচ্ছে, শুধু সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সঙ্গে পরামর্শের পর তিন মিত্রদেশে হামলা চালিয়েছে ইরানের বিপ্লবী বাহিনী। এমনকি হামলার আগে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদুল্লাহিয়ানের পরামর্শ নেওয়া হয়নি, এমনও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

তিন দেশে সাম্প্রতিক হামলা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ইরানের অবস্থান ক্ষুণ্ন করেছে বলেও মনে করা হচ্ছে। এসব ঘটনা ইরানের প্রতিরক্ষাকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে বলে বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন। সেই সঙ্গে ইরানের বিপ্লবী বাহিনীর বেপরোয়া আচরণ ও অগণিত ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতার প্রকাশ ঘটিয়েছে এসব হামলা।

আরও দেখুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
এমপি আনার হত্যাকাণ্ডে ‘হানি ট্র্যাপ’ শিলাস্তি রহমান ‘Pushpa 2’ is coming to Bangladesh in Hindi ইব্রাহিম রাইসি যেভাবে ৫০০০ মানুষকে হত্যা করেছিলো