বাড়ি শিল্প ম্যাগ আলোচনা কাঠপরানের দ্রোহ: জীবনমুখী প্রহরযাপন

কাঠপরানের দ্রোহ: জীবনমুখী প্রহরযাপন

34

প্রাচুর্য প্রবাল

একজন ছোটগল্পকারকে জীবনশিকারী হয়ে গল্পের বিষয়-আশয় অনুসন্ধানের পথে যাত্রা শুরু করতে হয়। যে কারণেই তাকে পার্থক্য করা যায় বহুদিক দিয়ে।যদিও তার ক্ষুদ্রত্ব এবং বিস্তার মূলত গল্প বা কাহিনিকে অবলম্বন করেই। কিন্তু জীবনের অনেক ঘটনা রয়েছে যা উপন্যাস বা ছোটগল্পের আঙ্গিকে সাজানো যায়না। খোঁজ করলে তার হদিস হয়তো পাওয়া যাবে গল্পের ভিতরেই। কিন্তু, জীবনের সব অনুভূতিই কি গল্পে রূপান্তর করা যায়? এসব অনুভূতিকে বড়জোড় ঘটনাতীত ঘটনা বা গল্প নাম দেওয়া যেতে পারে। গত শতকের নব্বই দশকে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের কয়েকজন গল্পকার অসামান্য ক্ষমতা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন।’ ছোটগল্পের মৃত্যু হয়েছে’- এ মতবাদ তারা মানতে নারাজ ছিলেন। এদের প্রত্যেকের লেখায় আলাদা মানসিকতা ফুটে উঠেছিলো। এটিই স্বাভাবিক ।
পরবর্তীতে এসময়ের অনেকেই সাম্যবাদী চেতনার দাবীদার হলেও গল্প  লেখার ক্ষেত্রে সাম্যবাদী নীতির কোনরকম বহিঃপ্রকাশ দেখাননি। একটি কথা সত্য যে, ছোটগল্প এবং উপন্যাস-পরবর্তী পর্যায়ে যারা এসেছেন ছোটগল্প নিয়ে তাদের অধিকাংশই অনুবাদ সাহিত্য চিন্তাকেই সচেতনভাবে পুঁজি করেছেন। কয়েকজন রয়েছেন ব্যতিক্রম।রিপন চন্দ্র মল্লিক এই ব্যতিক্রম ঘরানার একজন নিভৃতচারী গল্পকার।‘কাঠপরানের দ্রোহ’ তার গল্পগ্রন্থ।তার গল্পে অহেতুক কোন আবহ নেই। একেবারেই গল্প লিখতে বসে যাওয়া একজন গল্পকার তিনি। প্রাত্যহিক সময়ের টানাপোড়েন আর সময় চিন্তা রিপনের গল্পের প্রধান উপজীব।তিনি গল্প বলতে এসে কেবল গল্পই বলে যান, নাড়া দিয়ে যান সময় এবং রেখে যান জীবনবাস্তবতার এক দীর্ঘবয়ান। তার এইগ্রন্থের- জোছনাঘরে কান্নার স্বর, কাঠপরানের দ্রোহ, গুজবের দিন, অন্ধ পাখির চোখে, কেবলই স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছি, রক্তে পোষা নীলপাখি, ফসলের ফল, কালোদাগ, রঙিলা পুতুলের গন্ধ, আত্মপরিচয় ইত্যাদি গল্প অনন্য এক আবহ তৈরি করতে সক্ষম পাঠকের মগজে।
ভারতীয় এক প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক মুল্ক, যিনি ইংরেজি ভাষাকেই বেছে নিয়েছিলেন সাহিত্যচর্চার মাধ্যম হিসেবে। তিনি একটি লেখায় বলেছিলেন ‘হাতির দাঁতের মিনারে বসে রাস্তার জীবনকে জানা যায় না। রাস্তার জীবন মানে বাস্তবতার মানচিত্র। জীবনের প্রয়োজনে একজন গল্পকারকে বদলে যেতে হয হয়তো, তার সাথে বদলে যায় তার জীবনযাপনের নানা উপাচার। মানুষের মাঝে অনন্য সাধারণ হয়ে গল্পকার বেঁচে থাকতে চান, সাধারণ কিছু বোধ বদলের পাশাপাশি তিনিও বদলে দেন তার ছোটগল্প।’ রিপন চন্দ্র মল্লিক এসবের গভীর থেকেই তুলে এনেছেন শব্দশস্য। বোধের দিক থেকে এই গল্পগ্রন্থটি দু’টি পর্বে বিভক্ত। দু’টি পর্ব আলাদা হলেও গল্পের গতি-প্রকৃতি অনেকাই নিত্য পরিচিত ঘরানা থেকে ভিন্নতর।রিপন চন্দ্র মল্লিক তার ছোটগল্পে নিজেকে বিশ্লেষণ করেছেন আভিজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায়। তিনি তার গল্পকে নিজস্ব মনন আর চিন্তার রেশে মিশ্রণ করে বারংবার হেঁটে যান অনির্বচনীয় এক ভালোলাগার দিকে।
 একজন লেখককে দৃষ্টি দিতে হবে জীবনের ভেতরে। যতখানি পারা যায়, জীবনকে জানতে হবে।’ রিপন সেই কাজটি করেছেন তাঁর লেখার মাধ্যমে।
এই গ্রন্থে সূচিবদ্ধ একুশটি ছোটগল্পেই রিপন দেখিয়েছেন তার নিজস্ব  স্কেচবুকের সফল উপস্থিতি। তার সৃষ্ট চরিত্র  খোঁড়া আলম কিংবা মনোয়ারা ক্লার্ক এর মতো অসংখ্য মানুষ রয়েছে এইসময়ে, সমাজে। তারা নিজেরাই জীবন্ত গল্প হয়ে আছেন সময়ের প্রয়োজনে। রিপন তার গল্পে সমাজকে দেখিয়েছেন অন্যরকম চোখের দৃষ্টিতে। তার বয়ান ভঙ্গি অসাধারণ এবং যৌক্তিক তার গাল্পিক উপস্থাপন। শব্দের পাশাপাশি শব্দ বসানোর গতিময়তা এবং শব্দের ফাঁকে ফাঁকে যে শূন্যতা অনুধাবিত হয় সেই শূন্যতা বিশাল গভীরতা যা  কেবল সাদা কাগজের ফাঁকে ফাঁকে নৈমিত্তিক একধরনের বিষণ্নতায়ই তৈরি করে না সেই সাথে পাঠকের মগজের মননকে তাড়িত করে পরবর্তী শব্দ এবং পরবর্তী দ্রোহের পথে যাত্রার জন্য। বাংলা সাহিত্যের খুব কম ছোটগল্পেই এই বোধ তীব্রতর আঙ্গিকে চোখে পড়ে। রিপন চন্দ্র মল্লিক তার অবচেতন মন দিয়ে এঁকেছেন এমন কিছু দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস আর বিমূর্তচিত্র  বাংলাদেশের  ছোটগল্পের উদ্যানে অভিনব সংযোজন। তার গল্পের প্রধান উপজীব্য বিষয় মানুষের জীবনযাপনের গভীরে লুকানো বিশালশূন্যতা যা মানুষ সাধারণ দৃষ্টিতে খুব বেশি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় না। কাঠপরানের দ্রোহ গ্রন্থে এধরনের বিষয়গুলোই বারবার উঠে এসেছে। ছোটগল্পের  যে দীর্ঘতম হতাশা এবং দীর্ঘ কিছু বিষয় যা মানুষের যাপিত জীবনকে প্রভাবিত করে দারুণভাবে এরকম কিছু ঘোরের প্রতিচ্ছবি তার গল্পের উঠোনে ফুটে উঠেছে।
বাংলাদেশের প্রচলিত ছোটগল্পের প্রকৌশল, প্রকরণ নিয়ে নানামুখী মন্তব্য প্রচলিত এবং উপস্থাপিত হচ্ছে বর্তমান সময়ের সাহিত্য উঠোনে। অনেক গল্পকার অনুবাদসাহিত্যের আশ্রয় করে গল্প লিখতে শুরু করেন। তাদের গল্পকে শেষব্দি জবরদস্তিমূলক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ বলা চলে। রিপন চন্দ্র মল্লিক তাদের চিন্তার বিপরীতে অবস্থান করেন। একটি সার্থক গল্প লেখার জন্য  যেরকম লেখাটির নানান শৈলী সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হবে পাশাপাশি  থাকা আবশ্যক চিত্রকল্প নির্মাণের কলাকৌশল জ্ঞান। রিপন চন্দ্র মল্লিক তেমনি একজন গল্পকার তার প্রকাশকৌশল আলাদা এবং অনন্য ঘরানার। এ মন্তব্যেও স্বপক্ষে সমর্থন করে তার ছোটগল্পগ্রন্থ কাঠপরানের দ্রোহ।
কাঠপরানের দ্রোহ। রপিন চন্দ্র মল্লিক। প্রকাশক: ছন্নিপত্র।  মূল্য: ৪০০ টাকা।