বাড়ি অর্থ ও বাণিজ্য বৈদেশিক ঋণের বোঝা, পরিশোধ হবে কীভাবে?

বৈদেশিক ঋণের বোঝা, পরিশোধ হবে কীভাবে?

25
বিদেশিক ঋণের বোঝা পরিশোধ হবে কীভাবে

বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে নেওয়া ঋণের স্থিতি ছিল ১০০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন (১০ হাজার ৬৪ কোটি) ডলার। বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) বাংলাদেশ ব্যাংক এই তথ্য প্রকাশ করেছে।

৬ মাস আগেও বিদেশি ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলারের আশপাশেই ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুনে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৯৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত ছয় মাসে বিদেশি ঋণ বেড়েছে মাত্র এক বিলিয়ন ডলারের মতো। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি ঋণ নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। শুধু তাই নয়, আরও ঋণ নেওয়ার সুযোগ আছে। এছাড়া ঋণ সময়মতো পরিশোধের কারণে ঋণ দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়ে আছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, দেশের বিদেশি ঋণের স্থিতি মোট জিডিপির প্রায় ২৩ শতাংশ। বিদেশি ঋণের এই অনুপাত অর্থনীতির জন্য মোটেই উদ্বেগজনক নয় বলে মনে করে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ালেও দেশের জিডিপির আকারের তুলনায় এটি খুব বেশি নয়। মোট জিডিপির প্রায় ২৩ শতাংশ বৈদেশিক ঋণ—মানে এখনও অনেক বিদেশি ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) গত ডিসেম্বরের হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণদানে শীর্ষ দেশ ও সংস্থার মধ্যে ছিল বিশ্বব্যাংক, জাপান, এডিবি ও চীন। সাম্প্রতিককালে চীনা ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বিদেশি অর্থায়নে বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, মেট্রোরেল (লাইন-৬), হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ ইত্যাদি।

শুধু বৈদেশিক ঋণ নয়। অভ্যন্তরীণ নানা উৎসেও ঋণ রয়েছে সরকারের। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ-এর তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর শেষে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি ২০২৩ শেষে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৮৭ হাজার ১৫৮ দশমিক ৬ কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ বলছেন, বিদেশি ঋণ ইতোমধ্যে বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই ঋণ পরিশোধ করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে বলে জানান বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, সরকারের ঋণ অনেক আগেই বিপজ্জনক মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বিদেশি ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত রিস্কি উল্লেখ করে তিনি বলেন, চলতি বছর থেকে বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ বাড়তে থাকবে। ডলারের জোগান না বাড়লে পরিস্থিতি খুবই খারাপ দিকে মোড় নিতে পারে। আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বিদেশি ঋণ বাড়ছে, এটা দেশের জন্য উদ্বেগজনক।’ পরিস্থিতি সামাল দিতে চীন ও রাশিয়া থেকে যে সাপ্লাইয়ার ক্রেডিট নেওয়া হচ্ছে, তা এখনই বন্ধ করা জরুরি। তার মতে, বাংলাদেশের বাস্তবতায় বিদেশি ঋণ-জিডিপির অনুপাত হিসাব করাও অর্থহীন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ঋণের অনুপাত তুলনা করতে হবে সরকারের রাজস্ব আয়ের সঙ্গে। কোনও দেশের ঋণ-রাজস্ব অনুপাত ২০০-২৫০ শতাংশ পর্যন্ত মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশে ঋণ-রাজস্ব অনুপাত ৪০০ শতাংশের বেশি। আহসান এইচ মনসুর উল্লেখ করেন, সরকারি ব্যয় কমিয়েও এই ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব না। কেবল সমাধান একটি তা হলো রাজস্ব বাড়ানো। রাজস্ব বাড়াতে হবে। ধার করে বেশি দিন ঘি খাওয়া যায় না। এখন রাজস্ব খাতে মৌলিক সংস্কার আনা জরুরি। সরকারি কোনও কর্মকর্তার সঙ্গে রাজস্ব পরিশোধকারীর যোগাযোগ থাকবে না, এমন সিস্টেম চালু করতে হবে। এই খাতে অনিয়ম বন্ধ করতে হবে। তা না হলে রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব হবে না। এখন রাজস্ব আদায়ের পুরো বিষয়টিকে ঢেলে সাজাতে পারলে তিন থেকে পাঁচ বছর পরে ফল পাওয়া যাবে। আর যদি সরকার রাজস্ব আয় বাড়াতে না পারে, তাহলে ঋণ আরও বাড়তে থাকবে, পরিস্থিতি সামাল দিতে তখন অতিরিক্ত টাকা ছাপাতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বৈদেশিক এই ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে দুটি পথ আছে। একটি হচ্ছে সরকারের আয় বাড়ানো। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নতুন ঋণ দিয়ে পুরনো ঋণকে পরিশোধ করা। তিনি উল্লেখ করেন, নতুন ঋণ নিয়ে রিফাইন্যান্সিং তো বারবার করা যাবে না। এছাড়া রিফাইন্যান্সিং করে তো প্রবলেমটাকে সলভ করা যাচ্ছে না। তিনি মনে করেন, ঋণ পরিশোধের বিকল্প হতে পারে সরকারের ব্যয় কমানো। কিন্তু ব্যয় কমিয়ে এর সুফল পাওয়া যাবে না। তবে সরকারের ব্যয়কে যৌক্তিকীকরণ বা অপচয় কমানোর ওপরও জোর দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, দুর্নীতির কারণে সরকার অনেক অতিরিক্ত ব্যয় করে। এজন্য সরকারি যেসব ব্যয় না করলেও তেমন কোনও অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে না, এমন ব্যয় কমানো যেতে পারে।

জানা গেছে, চলতি বছর থেকে অনেক মেগা প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হচ্ছে। এতে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়বে। এমনিতেই দেশে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ায় আরও বেশি পরিমাণে ডলারের প্রয়োজন হবে। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী রেমিট্যান্স, রফতানি আয়সহ দেশের ডলার সংস্থান বাড়ানো যাচ্ছে না। বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয়ও থামানো যাচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিদেশি ঋণের বিপরীতে রিটার্ন আসছে স্থানীয় মুদ্রায় বা টাকায়, তাই ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিদেশি ঋণের ব্যয় বাড়ছে। এ কারণে ব্যয়বহুল বিদেশি ঋণ থেকে এখনই সতর্ক থাকতে হবে, যেন ঋণ পরিশোধে কোনও সমস্যা না হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১০০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের এই ঋণের মধ্যে ৭৯ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার নিয়েছে সরকারি খাত এবং বাকি অংশ নিয়েছে বেসরকারি খাত। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ ঋণ দীর্ঘমেয়াদি এবং বাকিগুলো স্বল্পমেয়াদি। গত ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ২ হাজার ৯৫ কোটি ডলার, যা গত সেপ্টেম্বরে ছিল ২ হাজার ১২৮ কোটি ডলার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৯ হাজার ৬৫২ কোটি ডলার। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়েছে ৪১২ কোটি ডলার। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৯ হাজার ৬৫৫ কোটি ডলার। তার মানে পরের তিন মাসে ৪ বিলিয়ন বা ৪০৯ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ বেড়েছে। এই সময়ে সরকার ৪৪২ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ নিয়েছে। তার বিপরীতে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের স্থিতি কমেছে ৬৪ কোটি ডলারের।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে সরকারের বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ২০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। ওই সময় বিদেশি উৎস থেকে দেশের বেসরকারি খাতের ঋণ নেওয়ার সুযোগ ছিল না। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৪ হাজার ১১৭ কোটি ডলার। গত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে তা ৯ হাজার ৮১১ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। অর্থাৎ গত আট বছরে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। গত ডিসেম্বর শেষে সেটি আরও বেড়েছে।

জনশুমারি ও গৃহগণনা শুমারির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। এই হিসাবে গত ডিসেম্বরের শেষে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৯২ ডলার (প্রায় ৬৫ হাজার টাকা)। আট বছর আগে মাথাপিছু ঋণ ছিল ২৫৭ ডলারের কিছু বেশি।