বাড়ি অপরাধ গোপন ভিডিও প্রতারণার হাতিয়ার যখন নারীর

গোপন ভিডিও প্রতারণার হাতিয়ার যখন নারীর

1
গোপন ভিডিও প্রতারণার হাতিয়ার যখন নারীর

পারিবারিকভাবে আলোচনার মাধ্যমে কুয়েতপ্রবাসী শাকিল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয় এক তরুণীর। শাকিল দেশে আসতে না পারায় উভয় পক্ষের সম্মতিতে ভিডিও কলে বিয়ে হয়। এর পর দু’জন ইমো ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করতেন। তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত গোপন ভিডিও এবং ছবি বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে তরুণী জানতে পারেন, তাঁর স্বামী মাদকাসক্ত। তিনি বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই যুবক ফেসবুকে ভুয়া আইডি খুলে স্ত্রীর গোপন ছবির সঙ্গে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য জুড়ে পোস্ট করেন। এতে বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে পড়েন তরুণী।

গত বছরের জুনে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর এ ঘটনায় মামলা হলে তদন্তে ভুক্তভোগীর অভিযোগের সত্যতা পায় পুলিশ।

এমন ঘটনা বিরল নয়। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে ভৌগোলিক দূরত্ব জয় করে ভার্চুয়ালি সম্পর্কে জড়ানো বা ভিডিও কলে বিয়ের ঘটনা অনেক বেড়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা হয়ে উঠছে প্রতারণার মাধ্যম। আবার পরিকল্পিতভাবে প্রতারণার উদ্দেশ্যে বিয়ের ঘটনাও ঘটছে। এ ছাড়া প্রেমের সম্পর্ক গড়ে, এমনকি বিয়ের পরও ভিডিও কলে ঘনিষ্ঠ সময় কাটানোর সুযোগে সঙ্গীর গোপন ছবি-ভিডিও সংরক্ষণ করে রাখা হচ্ছে। পরে সেসব অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। অথবা নারীর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হচ্ছে সেই গোপন ভিডিও-ছবি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো সমাজে দু’জন মানুষের সম্পর্ক কীভাবে শেষ হয়, তা থেকে ওই সমাজের মানুষের মানসিকতা বোঝা যায়। আমাদের মানসিক পরিপক্বতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কোনো কারণে বিচ্ছেদ বা সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হলে নিজেদের ভালো সময়ের স্মৃতি পুঁজি করে অন্যজনকে হেনস্তা করা তেমন মানসিকতারই প্রকাশ।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ শাখার উপকমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, এ ধরনের অপরাধ এখন অনেক বেড়েছে। অনেক মামলা হচ্ছে। প্রতিদিনই মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে এমন বহু অভিযোগ আসছে। তবে সবাই আসছেন প্রতারিত হওয়ার পর। এ জন্য আমরা নানাভাবে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করছি, যেন কেউ সম্পর্কে জড়ানোর আগে অপরজনের বিষয়ে ভালোভাবে জেনে নেন। কোনো অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

ক্ষোভ থেকে স্ত্রীর গোপন ছবি ছড়ান স্বামী

যাত্রাবাড়ীর ঘটনায় ভুক্তভোগী তরুণী শিক্ষার্থী। তাঁর মামলাটির তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সংস্থাটির বিশেষায়িত তদন্ত ও অভিযান (এসআইঅ্যান্ডও-দক্ষিণ) শাখার এসআই শাহানাজ ফাতেমা সমকালকে বলেন, তরুণীর অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা হলে সংশ্লিষ্ট দুটি ফেসবুক আইডি পর্যালোচনার জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠানো হয়। সিআইডির ডিজিটাল ফরেনসিক শাখার বিশেষজ্ঞরা মত দেন, ওইসব আইডি থেকে পোস্ট করা অশালীন ছবি ও ভিডিওর সঙ্গে ভুক্তভোগীর ছবির মিল পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে ভুক্তভোগীর চারিত্রিক বিষয়ে কটাক্ষ করে অশ্লীল মন্তব্য ও হুমকি দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। ঘটনার পর অভিযুক্ত শাকিল আর দেশে ফেরেননি। তদন্তে প্রতীয়মান হয়, তিনি ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে ভুক্তভোগীর নামে খোলা দুটি ফেসবুক আইডি থেকে অশালীন ছবি-ভিডিও এবং কমেন্টসহ মানহানিকর কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য পোস্ট করেন। ভুক্তভোগী তরুণী জানান, সাবেক স্বামীর এমন আচরণের জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। এক পর্যায়ে এর বিরুদ্ধে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেন।

ইমোতে কথা বলার সময় স্ক্রিন রেকর্ডিং

প্রেমের সম্পর্ক গড়ে, যথানিয়মে বিয়ে করে বা নামকাওয়াস্তে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার পর প্রতারণা ও নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে। এমন ঘটনার শিকার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বেগুনবাড়ী এলাকার এক তরুণী। তিনি বেসরকারি একটি হাসপাতালের কর্মী। তিনি যে বাড়িতে থাকেন, তার তৃতীয় তলায় থাকতেন মো. সুলতান। তিনি এক রাতে তরুণীকে ধর্ষণ করেন। পরে এ ঘটনা জানাজানি হলে ‘সমাজে মুখ দেখাতে পারবি না’– বলে তাঁকে বিয়েতে রাজি করান। তরুণী সমকালকে জানান, নানাভাবে মেয়েদের ফাঁদে ফেলে পাঁচটি বিয়ে করেছেন সুলতান। তিনি ইমোতে কথা বলে কৌশলে তরুণীর আপত্তিকর ভিডিও সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন। এর পর টাকার দাবিতে শুরু হয় নির্যাতন। নির্যাতনের কারণে দু’বার তাঁর গর্ভের সন্তানের মৃত্যু হয়। তার পরও টাকা না দিলে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। এক পর্যায়ে সত্যিই তাঁর স্বামী গোপন ভিডিও বন্ধুদের ইমোতে পাঠিয়ে দেন।

২০২২ সালের নভেম্বরের ওই ঘটনায় ভুক্তভোগীর করা মামলাটির তদন্ত করে পিবিআইর এসআইঅ্যান্ডও উত্তর শাখা। তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মেহেদী হাসান বলেন, ইমোতে কথা বলার সময় স্ক্রিন রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে তরুণীর গোপন ভিডিও ধারণের প্রমাণ মিলেছে।

মামুনের ভিডিও কলের ফাঁদে অর্ধশত তরুণী

সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয়ে ফেসবুকে তরুণীদের সঙ্গে পরিচিত হতেন একটি ওয়ার্কশপের কর্মচারী মমিনুল ইসলাম ওরফে মামুন ইসলাম। দ্রুত সখ্য গড়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতেন। এর পর ভুয়া কাবিননামায় বিয়ে করে কিছুদিন একসঙ্গে থাকতেন। পরে দূরে অবস্থানের সময় স্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলার ছলে আপত্তিকর ছবি-ভিডিও সংরক্ষণ করতেন। পরের ধাপে সেগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করতেন। সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সেজে অন্তত ১০টি বিয়ে করেন মামুন। শেষে পল্টন থানায় এক ভুক্তভোগীর করা মামলার সূত্র ধরে ২০২২ সালের ৩১ আগস্ট তাঁকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। সংস্থাটির বিশেষ পুলিশ সুপার এস এম আশরাফুল আলম তখন জানান, মামুনের মোবাইল ফোনে অর্ধশতাধিক তরুণীর সঙ্গে ভিডিও কলে কথোপকথন ও প্রচুর আপত্তিকর ভিডিও পাওয়া গেছে।

ভিডিও কলে বিয়ে কি বৈধ?

বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার সমিতির সভাপতি মাওলানা মো. খলিলুর রহমান সরদার বলেন, বর প্রবাসে থাকলে অর্থাৎ ফোনে বিয়ে হলেও তা বৈধ। এ ক্ষেত্রে নিয়ম হলো, বর অনুমতিপত্র পাঠাবেন। তাতে উল্লেখ থাকবে যে, তাঁর পক্ষে বাবা, বড় ভাই বা এমন দায়িত্বশীল কেউ উকিল হিসেবে কাবিননামায় স্বাক্ষর করবেন। আবার এই স্বাক্ষরের সময়ও দু’জন সাক্ষী রাখতে হবে। বিয়ের অনুষ্ঠানে বর না থাকলেও উভয় পক্ষের সংশ্লিষ্টদের উপস্থিত থাকতে হবে। অর্থাৎ পরে কোনোভাবেই যেন বিয়ে অস্বীকারের কোনো সুযোগ না থাকে। তবে কনে বিদেশে থাকলে বিয়ের বিধান এখনও চালু হয়নি।

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, আমাদের দেশে বিয়ের ক্ষেত্রে আইনগত ভিত্তির চেয়ে ধর্মীয় ও সামাজিক বৈধতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিয়ে যে মাধ্যমেই হোক, বর-কনের পরস্পরের বিষয়ে ভালোভাবে খোঁজ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। কোনোভাবেই তাড়াহুড়ো করা উচিত নয়। এ ধরনের ঘটনা এড়াতে মানুষের ব্যক্তিত্ব, সম্মান, মর্যাদা বোঝার সক্ষমতা তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তবে সেটি সময়সাপেক্ষ। দ্রুত পদক্ষেপ হলো আইনের কঠোর প্রয়োগ। কেউ যেন বিয়ে বাণিজ্য না করতে পারে, স্বাভাবিকভাবে শেষ না হওয়া সম্পর্ক নিয়ে যেন কেউ অনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে না পারে– সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হবে। এতে অন্যরা সতর্ক হবে।