বাড়ি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ঢাকার অভিনেত্রীও ডিপফেকের শিকার! ভুয়া ভিডিও চিনবেন কীভাবে

ঢাকার অভিনেত্রীও ডিপফেকের শিকার! ভুয়া ভিডিও চিনবেন কীভাবে

3
ঢাকার অভিনেত্রীও ডিপফেকের শিকার! ভুয়া ভিডিও চিনবেন কীভাবে

সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে এক নারীর ব্যক্তিগত ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। দাবি করা হচ্ছে, এটি ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী তানজিন তিশার ভিডিও। অনলাইন যাচাই ও মিডিয়া গবেষণা প্ল্যাটফর্ম ডিসমিসল্যাব বলছে, এটি একটি ভুয়া ভিডিও।

ডিপফেক কী: ডিপফেক প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজে ও সূক্ষ্মভাবে কোনো ব্যক্তির চেহারা কিংবা কণ্ঠ নকল করা যায়। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেকোনো আপত্তিকর ভিডিওতে যে কারও চেহারা বসিয়ে ভুয়া ভিডিও বানানো যায়। এই ধরনের ভুয়া ভিডিও ‘ডিপফেক’ ভিডিও নামে পরিচিত। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই ধরনের ভুয়া ভিডিও শনাক্ত করা বেশ কঠিন।

বাংলাদেশে ডিপফেক কতটা বিপজ্জনক
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) উত্থানের ফলে ডিপফেক প্রযুক্তি আরও সহজ হয়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে আশঙ্কাজনকভাবে ডিপফেক প্রযুক্তির অপব্যবহার বাড়ছে। এখন নিখরচায় কিংবা খুব অল্প খরচে ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়।
যেকোনো আপত্তিকর ভিডিওতে যে কারও চেহারা বসিয়ে তা ছড়িয়ে দিতে পারে সাইবার অপরাধীরা। ডিপফেক প্রযুক্তিতে এ ধরনের ভুয়া ভিডিও সূক্ষ্মভাবে তৈরি করা হয়। এর ফলে তা সাধারণ মানুষের পক্ষে শনাক্ত করা বেশ কঠিন।
বাংলাদেশের বহু মানুষ বিনোদনের অংশ হিসেবে ফেসবুক রিলস, ইউটিউব শর্টস ও টিকটকে ভিডিও দেখেন। এসব প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে পড়া ভুয়া ভিডিও অনেকে বিশ্বাসও করেন।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে ডিপফেক অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ, সামাজিক মাধ্যমে অনেকে ভুয়া ভিডিও ও প্রকৃত ভিডিওর মধ্যে পার্থক্য করার মতো যথেষ্ট চিন্তা করেন না। এর ফলে বাংলাদেশে ডিপফেকের চ্যালেঞ্জটা আরও বেশি।
হালে ডিপফেক প্রযুক্তি আরও সহজলভ্য হওয়ায় এই চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে বলে মনে করেন এই তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। তিনি আশঙ্কা করেন, শুধু তারকা কিংবা রাজনীতিবিদই নন, আগামীতে যে কাউকে হেয় করতে, ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে কিংবা প্রতারণার জন্যও ডিপফেকের অপব্যবহার বাড়তে পারে।

বাংলাদেশে ডিপফেক অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ, সামাজিক মাধ্যমে অনেকে ভুয়া ভিডিও ও প্রকৃত ভিডিওর মধ্যে পার্থক্য করার মতো যথেষ্ট চিন্তা করেন না। এর ফলে বাংলাদেশে ডিপফেকের চ্যালেঞ্জটা আরও বেশি।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ

এ ধরনের ভুয়া ভিডিও বিশ্বজুড়েই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটিকে আরও ‘বড় সমস্যা’ বলে মনে করেন এএফপির ফ্যাক্টচেক এডিটর (বাংলাদেশ) কদরুদ্দীন শিশির। গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন,‘বিশেষ করে বাংলাদেশে যেখানে বেশির ভাগ মানুষের প্রযুক্তিগত সাক্ষরতা সীমিত বা নেই, সেখানে এটি আরও বড় সমস্যা। ডিপফেক কনটেন্ট দিয়ে সহজে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়।
গত বছরের আগস্টে বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানা, নিপুণ রায়সহ বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদের ডিপফেক ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছিল। ডিসমিসল্যাব জানিয়েছিল, সেগুলো ভুয়া ভিডিও।
কদরুদ্দীন শিশিরের ভাষ্যে, মূলত সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কাউকে হেয় করতে ডিপফেক ভিডিও বানানো বা ছড়ানো হয়ে থাকে।
গত পাঁচ থেকে ছয় বছরে বিশ্বে ডিপফেক ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে বলে ধারণা সুমন আহমেদের। বাংলাদেশে বছরখানেক ধরে ডিপফেক ভিডিও বাড়তে শুরু করেছে। তবে কবে থেকে ডিপফেক বানানো শুরু হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
এর আগে মাহিয়া মাহি, পরীমনি, মেহজাবীন চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন ঢাকার চিত্রতারকার ভুয়া ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে। তবে সেগুলোর কোনোটিই ডিপফেক ছিল না, ম্যানুয়ালি সম্পাদনা করে এ ধরনের ভুয়া ভিডিও বানিয়েছিল সাইবার অপরাধীরা।

কদরুদ্দীন শিশির বলন, ‘আগের ম্যানুয়ালি সম্পাদিত ভিডিওতে ম্যানিপুলেশনের মাত্রা সীমিত ছিল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেই সীমারেখা উঠিয়ে দিয়েছে। এখন আগের চেয়ে অনেক কম সময়ে, কম খরচে বেশি বিশ্বাসযোগ্য ভুয়া ভিডিও বানানো সম্ভব।’

২০১৯ সালে প্রকাশিত গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেনসিটি এআইয়ের এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে বানানো ডিপফেক ভিডিওর ৯৯ শতাংশই নারীর। এর মধ্যে ৯৬ শতাংশ ডিপফেপই তাঁদের অনুমতি ছাড়া করা হয়েছে।

নারীরাই কেন লক্ষ্যবস্তু
হলিউডের নাটালি পোর্টম্যান, এমা ওয়াটসন কিংবা বলিউডের প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, আলিয়া ভাট, রাশমিকা মান্দানা থেকে ঢাকার তানজিন তিশা—বিশ্বজুড়ে ডিপফেকের শিকার বেশির ভাগ ভুক্তভোগীই নারী। ডিপফেক পর্নোগ্রাফি নিয়ে ‘মাই ব্লড জিএফ’, ‘অ্যানাদার’ বডিসহ বেশ কয়েকটি তথ্যচিত্রেও নারীর সঙ্গে ঘটা ভয়াবহতার তথ্য উঠে এসেছে।
২০১৯ সালে প্রকাশিত গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেনসিটি এআইয়ের এক প্রতিবেদনের বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, বিশ্বজুড়ে বানানো ডিপফেক ভিডিওর ৯৯ শতাংশই নারীর। এর মধ্যে ৯৬ শতাংশ ডিপফেপই তাঁদের অনুমতি ছাড়া করা হয়েছে।
গত বছরের ২৩ জুন বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাজ্যের ডারহাম ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ক্লেয়ার ম্যাগলিন বলেছেন, নারীদেরই এ ধরনের হয়রানির ঝুঁকি বেশি থাকে। মূলত পুরুষেরাই এটি করে থাকেন।

নারী সেলিব্রিটিদের ডিপফেক ভিডিও ‘সেলেবল’; অনলাইনে আর্থিকভাবে লাভবান হতে কেউ কেউ তাঁদের ডিপফেক যৌন কনটেন্ট বানান।

ফ্যাক্টচেকার কদরুদ্দীন শিশির

যৌন সহিংসতা, সাইবার হয়রানি নিয়ে কাজ করছেন অধ্যাপক ক্লেয়ার ম্যাগলিন। নারীদের লক্ষ্যবস্তু বানানোর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীর সঙ্গে ঘটা যেকোনো অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির খুব কম; সেটা ডিপফেক পর্নোগ্রাফির ক্ষেত্রেও দেখা যায়। এই ধরনের অপরাধকে ছোট করে দেখা হয়।’
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ কিংবা বাংলাদেশ—পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তের নারীদেরই ডিপফেকের শিকার হতে দেখা গেছে। ঢাকার ফ্যাক্টচেকার কদরুদ্দীন শিশির বলেন, নারী সেলিব্রিটিদের ডিপফেক ভিডিও ‘সেলেবল’; অনলাইনে আর্থিকভাবে লাভবান হতে কেউ কেউ তাঁদের ডিপফেক যৌন কনটেন্ট বানান। এর বাইরে ব্যক্তিগত বিষয়ও থাকতে পারে, আবার প্রতিহিংসার কারণেও অনেকে ডিপফেক ভিডিও বানান বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা ‍বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারীকে এখনো আমরা মানুষ হিসেবে দেখি না। নারীকে পণ্য হিসেবে দেখা হয়। নারীকে সেক্সুয়াল পার্সপেক্টিভ থেকে দেখা হয়।’

নারীকে এখনো আমরা মানুষ হিসেবে দেখি না। নারীকে পণ্য হিসেবে দেখা হয়। নারীকে সেক্সুয়াল পার্সপেক্টিভ থেকে দেখা হয়।

অধ্যাপক তানিয়া হক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা ‍বিশ্ববিদ্যালয়

ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি
ডিপফেকের অপব্যবহার নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের মধ্যে ইউটিউব ও ফেসবুকের মতো বড় প্ল্যাটফর্মগুলো নড়েচড়ে বসেছে। এমনকি নীতিমালাও হালনাগাদ করেছে। ভারতে ডিপফেক ভিডিও রোধে অভিযানও চালিয়েছে সরকার। বাংলাদেশে যাঁরা এ ধরনের ডিপফেক ভিডিও বানিয়ে প্রচার করেন, তাঁদের শাস্তির দাবি করেছেন অভিনেত্রী রুনা খান।
কারও অনুমতি ছাড়া আপত্তিকর ছবি কিংবা ভিডিও বানিয়ে প্রকাশ করা সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এ দণ্ডনীয় অপরাধ। ডিপফেকের শিকার ভুক্তভোগীরা অভিযোগ জানালে এই আইনে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টার, ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ ও পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের অভিযোগকেন্দ্রে অভিযোগ জানাতে পারেন।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত ডিআইজি রেজাউল মাসুদ গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা এখনো কোনো ডিপফেকের অভিযোগ পাননি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, সিআইডির ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবে সাইবার অপরাধী শনাক্ত করা হয়, সেখানে ডিপফেকের পেছনের অপরাধীদেরও শনাক্ত করা সম্ভব।

সিআইডির ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবে সাইবার অপরাধী শনাক্ত করা হয়, সেখানে ডিপফেকের পেছনের অপরাধীদেরও শনাক্ত করা সম্ভব।

সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত ডিআইজি রেজাউল মাসুদ

ডিপফেক ভিডিও চিনবেন কীভাবে
১. ডিপফেক ভিডিওতে অনেক ক্ষেত্রেই কিছু অস্বাভাবিকতা থাকে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তির শরীরী ভাষায় অস্বাভাবিকতা থাকে। কখনো কণ্ঠেও গতির অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। মুখের ভঙ্গির সঙ্গে কণ্ঠ মেলে না। এর ফলে চতুরতার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডিপফেক ভিডিওতে কণ্ঠস্বর থাকে না।
২. সাধারণত ব্যক্তির মুখাবয়ব অনুকরণ করতেই বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়। এতে শরীরের বাকি দৃশ্যমান অংশে প্রকৃত বিষয়বস্তুর (যাঁর ভিডিও বলে দাবি করা হচ্ছে) সঙ্গে নানান অমিল রয়ে যায়। পোশাক বা মুখভঙ্গির সঙ্গে শরীরের নড়াচড়ারও অমিল থাকতে পারে।
৩. ডিপফেক ভিডিওর দৈর্ঘ্য সাধারণত কয়েক সেকেন্ডের হয়ে থাকে। কারণ, দীর্ঘ ভিডিও বানানো খরচের বিষয়।
৪. এ ধরনের ভিডিওতে ব্যক্তির শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন ঠোঁট, চোখ, চোখের পাতার নড়াচড়া, কান, নাক, চুল ইত্যাদির আকার ও গঠনের অসংলগ্নতা থাকে। কিছু ক্ষেত্রে রিভার্স ইমেজ সার্চ করেও কোনো ডিপফেক ভিডিওর ব্যপারে ইন্টারনেটে সূত্র পাওয়া যেতে পারে।