অধিকার ও মর্যাদাপ্রবন্ধ/ নিবন্ধ

মজুরি বাড়েনি, তাই ‘যৌনকর্মে’ নামতে বাধ্য হচ্ছেন পোশাক শ্রমিকরা

গার্ডিয়ানের রিপোর্ট:

প্রতিরাতে রুবি রফিককে (ছদ্মনাম) তার ছোট রুমের ঠান্ডা, শক্ত মেঝেতে জেগে থাকতে হয়। তিনি শুধু চিন্তা করেন যে কীভাবে তার পরিবার এই শীতটা পার করবে। তার পাশেই একটি দাতব্য সংস্থার দেয়া কম্বল গায়ে শুয়ে আছে তার ১৩ বছরের মেয়ে মায়া। দুই সন্তানের মা রুবি প্রতি রাতে তার সন্তানদের ঘুমিয়ে পড়ার জন্য অপেক্ষা করেন। এরপর তিনি বাসা থেকে বের হয়ে আসেন, চলে যান কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত বাজারের দিকে। কোনো পুরুষ তার দিকে এগিয়ে আসবে, সে আশায় বসে থাকেন তিনি। রুবি বলেন, তাদেরকে নিজের বিষয়ে কিছু বলতে হয় না। আত্মসম্মান আছে এমন কোনো নারী এই রাতের বেলা রাস্তায় থাকে না।
দিনের বেলা পোশাক শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তিনি। কিন্তু মূল্যস্ফীতির কারণে যেভাবে জীবনযাপনের ব্যয় বাড়ছে তাতে রাতের বেলা যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই রুবির কাছে। আগে যদিও এত খারাপ অবস্থা ছিল না তার।

সাধারণত এক বেলা না খেলেই কিংবা মায়ার লাঞ্চবক্সে খাবার একটু কমিয়ে দিয়েই চালিয়ে নিতে পারতেন তিনি। কিন্তু তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে গেলো।

তার ১৬ বছরের ছেলে সাকিব ক্ষুধার্ত হয়ে চুরি করতে শুরু করে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে রুবি আর তার বাসা ভাড়া দিতে পারছেন না। তিনি ঋণ নিয়ে সামাল দেয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু সেই ঋণ পরিশোধেও তাকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। গত বছর থেকে তার অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে চালিত করা ৪০ লাখ শ্রমিকদের মধ্যে একজন এই রুবি। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম প্রধান পোশাক উৎপাদনকারী দেশ। কিন্তু এত উৎপাদন সত্ত্বেও বাংলাদেশে এখনও বিশ্বের সর্বনিম্ন মজুরি রয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে প্রতি মাসে মাত্র আট হাজার টাকা বা ৫৭ পাউন্ড বেতন চলছে।

গত নভেম্বর মাসে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ নিয়ে দর কষাকষির সময় রাজধানী জুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে ন্যূনতম বেতন বাড়িয়ে সরকার মাসে ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে। কিন্তু এরপরেও বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে, যা পরবর্তীতে সহিংস রূপ নেয়। শ্রমিকরা বলছেন সরকার নির্ধারিত এই মজুরি তাদের দাবি ২৩ হাজার টাকা থেকে অনেক কম। তাদের মৌলিক জীবনযাত্রার খরচ মেটাতে এবং তাদের পরিবারকে অনাহার থেকে বাঁচাতে এই মজুরি প্রয়োজন তাদের।

যুক্তরাজ্যের হাই স্ট্রিটের জন্য পোশাক তৈরি করা বাংলাদেশি শ্রমিকরা গত মাসে বলেন যে, তাদের বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য তাদের চুরি করা ছাড়া আর উপায় নেই। রুবি যেই কারখানায় কাজ করেন তা টেসকো, মাতালান এবং নেক্সট সহ বড় বড় বৃটিশ ব্র্যান্ডগুলির কাছে পোশাক বিক্রি করে। বড়দিনের আগ পর্যন্ত তারা ‘সান্তা’স লিটল হেল্পার’ লেখা উৎসব জাম্পার তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন। রুবি নিজে কখনও সিনেমাটি দেখেননি কিন্তু তার হাস্যোজ্জ্বল সবুজ মুখটি তার কাছে মজার লেগেছে।

তবে তার কাছে তার জীবন মজার নয়। তাকে সপ্তাহে সাত দিন ১০ ঘণ্টা করে কাজ করার পরেও তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি সপ্তাহে প্রায় ১৫ পাউন্ড উপার্জন করেন। হাজার হাজার জাম্পারের মধ্যে মাত্র একটির খুচরা মূল্যের চেয়ে কম আয় করেন তিনি। আশা করা হয়েছিল যে, নতুন ন্যূনতম মজুরি ডিসেম্বরে কার্যকর হবে। কিন্তু এখনও তা পরিশোধ করা হয়নি।

তাদের অবস্থা ক্রমশ ভয়াবহ হয়ে উঠলে, রুবির মতো অনেকেই বেঁচে থাকার জন্য যৌন কর্মে বাধ্য হচ্ছেন। তাদেরকে এ জন্য প্রায়শই বড় ঝুঁকি নিতে হয়। কয়েক মাস আগে একজন লোক রুবির কাছে ৫০০ টাকা অফার করে। তিনি একজন ক্লায়েন্ট থেকে যা পান এই টাকা তার দ্বিগুণ। রুবি ভাবেন, আজ তিনি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারবেন। গাড়িতে ওঠার আগে ওই টাকা তিনি কাছের এক দোকানদারের কাছে রেখে যান। কিন্তু যখন তিনি ওই ব্যক্তির বাড়িতে পৌঁছল, তখন সেখানে আরও ১০ জনকে দেখতে পান রুবি।

তিনি বলেন, আমি তাৎক্ষণিকভাবে তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি কিন্তু তারা দরজা বন্ধ করে দেয়। তারা আমাকে গালাগালি করতে থাকে। একপর্যায়ে আমি কাঁদতে শুরু করি। তারপর যে লোকটি আমাকে সেখানে নিয়ে এসেছিল তিনি আমাকে বলেন যেনো আমি তার দেয়া টাকা ফেরত দিয়ে চলে যাই। কিন্তু আমি তাদের বলি যে, আমার কাছে ওই টাকা এখন নেই। তিনি তখন আমার শরীরে ওই টাকা খুজতে থাকেন।

রুবি জানান, তার কাছে টাকা না পেয়ে তাকে বেদম মারতে শুরু করেন তিনি। তারা আমার মাথা টেবিলে চেপে ধরেন এবং এক পর্যায়ে তাকে বাইরে ফেলে দেন। তিনি অশ্রুসিক্তভাবে বলেন, আমি ভেবেছিলাম সেদিন আমি মারা যাব। আমি ভাবতে থাকি যে, আমি মারা গেলে আমার সন্তানদের কী হবে? আমার মেয়ের পরিণতিও কি আমার মত হবে? আমি এর চেয়ে খারাপ কিছু কল্পনা করতে পারি না।

ওই ঘটনার পরেও রুবি বলেন যে, তার জন্য যৌন কাজ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কোন বিকল্প নেই। সবকিছুরই এত দাম বেড়েছে যে এখন ডিম কেনাও বিলাসিতা হয়ে গেছে। নতুন জামাকাপড় কেনাতো দূরের কথা, আমি গত পাঁচ বছর ধরে এই একই জাম্পার পরে আছি। এটি একসময় সুন্দর হলুদ রঙের ছিল। এখন এটি কাদার মত বাদামী হয়ে গেছে।

প্রতিদিন কাজের পরে রুবি মরিয়া হয়ে অপেক্ষা করেন যে সেদিন তিনি কোন ওভারটাইম শিফট পাবেন কিনা। কিন্তু এটা সবসময় সম্ভব নয়। তাই আমি নতুন ক্লায়েন্টের খোজে বাজারে যাই।

রুবি সাধারণত প্রতি ক্লায়েন্টের থেকে ২০০ টাকা করে নেয়। দিনে এমন দুই বা তিনজনকে সেবা দেন তিনি। তিনি এই অর্থ ব্যবহার করেন খাবার কেনার জন্য। আর তিনি কারখানা থেকে যে আয় করেন তার বেশিরভাগই খরচ হয় ভাড়া, বিল এবং তার সন্তানদের পড়ালেখার জন্য। রুবি বলেন, যখন আমি বাড়ি ফিরে যাই, তখন সাধারণত মধ্যরাত হয়ে যায়। আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত বোধ করি। আমি জানি না আমার শরীর আর কতটা নিতে পারে। আমি শুধু আমার সন্তানদের ভবিষ্যত দেখার জন্য অপেক্ষা করছি। আমার মেয়ে মায়া ডাক্তার হতে চায়। সে এমন সব কিছুর স্বপ্ন দেখে যা আমি কল্পনাও করতে পারি না। একজন মা হিসেবে, আমার একমাত্র আসল কাজ হল সেই স্বপ্নগুলোকে সত্যি করা।

প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে, রুবি কিছু তার হাত গরম করার জন্য একটি ছোট আগুন জ্বালান। মাঝে মাঝে তিনি চুপচাপ গুন গুন করে গান গায়। তিনি ভাবেন, তার বানানো জাম্পারগুলো তাদের গন্তব্যে পৌঁছেছে কিনা। তিনি বলেন, কেউ যদি বাংলাদেশে তৈরি ক্রিসমাস জাম্পার পরেন তাহলে তার জানা উচিৎ যে, আমার মতো কর্মীরা সেই পোশাকগুলি তৈরি করে যা তাদেরকে আনন্দ দেয়। কিন্তু বিনিময়ে আমরা যা পাই তা হল সীমাহীন দুঃখের জীবন। আমরাও মানুষ, আমরা মেশিন নই। আমরাও কি একটু আনন্দের যোগ্য নই?

এ নিয়ে টেসকোর একজন মুখপাত্র বলেন, টেসকো ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধিকে সমর্থন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা শ্রমিকদের এবং তাদের পরিবারের মৌলিক চাহিদাগুলিকে পূরণ করবে। আমরা আমাদের সরবরাহ শৃঙ্খলে থাকা সমস্ত শ্রমিকদের যেনো প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান করা হয় তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

আরও দেখুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Bangladeshi mountaineer Babar Ali climbs Mount Everest সাঁতারের নিষিদ্ধ পোশাকে নারীদের ফ্যাশন শো সৌদিতে অভিনেতা জয় ও মিষ্টি জান্নাতের চুমুর দৃশ্য কোথায়?