বাড়ি প্রবাস ইউরোপ পূর্ব ইউক্রেনে আসলে কি ঘটছে?

পূর্ব ইউক্রেনে আসলে কি ঘটছে?

0
পূর্ব ইউক্রেনে আসলে কি ঘটছে

মারিনকা শহরটিতে ১০ হাজারের বেশি মানুষের বাস। ইউক্রেনের সরকারি বাহিনী ও রুশপন্থী বিদ্রোহীদের একেবারে সামনে পড়েছে দোনেৎস্কের পশ্চিম প্রান্তের এ শহরটি। রুশপন্থী বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত দনবাসের দুটি অঞ্চলের স্বঘোষিত রাজধানী দোনেৎস্ক।

২০১৪ সাল থেকেই এই অঞ্চলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর লড়াই চলছে। এতে ১৪ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। অনেকেই এখনকার গোলাগুলির ঘটনায় অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এখনকার ভবনগুলোতে এখন যুদ্ধের ছাপ স্পষ্ট। তবে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের উত্তেজনা নিয়ে কিছুদিন ধরে ওই অঞ্চলে উদ্বেগ বাড়ছে। কয়েক বছরের মধ্যে সেখানে সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। সেখানকার আবাসিক এলাকা, এমনকি স্কুলেও হামলা হয়েছে।

গাছের মাথাগুলো কাঁপছে। কিছু একটা ছুটে আসছে। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের মারিনকা শহরের বাসিন্দা ভ্যালেন্তিনা গর্দেয়েভা যতক্ষণে বিষয়টি বুঝতে পারলেন, ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। তিনি ছুটে গিয়ে কাছের একটি দোকানে আশ্রয় নিলেন। তাঁর বাঁ হাতের নরম মাংস ছিদ্র করে শক্ত ধাতব কিছু বেরিয়ে গেছে। ৬৫ বছর বয়সী এ নারী বলেন, ‘আমি একটা ব্যাগ ধরে ছিলাম। হাতে যন্ত্রণা টের পেলাম। তারপর ব্যাগ বেয়ে ছুটল রক্তধারা।’

ভ্যালেন্তিনার হাতের বুড়ো আঙুল আর কবজিতে এখন ব্যান্ডেজ বাঁধা। গত বৃহস্পতিবার রুশপন্থী বিদ্রোহীদের ছোড়া গুলিতে যে চারজন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন, তাঁদের একজন ভ্যালেন্তিনা। তিনি দাবি করেছেন, মারিনকায় বাস থামার যে স্থানটিতে তিনি গুলিবিদ্ধ হন, সেখানকার একটি স্কুল বিদ্রোহীদের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গেছে।

গত শনিবার ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, মুখোমুখি লড়াই তীব্র হয়েছে। দেশটির পূর্বাঞ্চলের বন্দরনগরী মারিওপুলের সেনারা বলেছেন, গত শুক্রবার রাতে ভারী গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তাঁরা বিস্ফোরণের অডিও রেকর্ড সরবরাহ করেছেন। গত শনিবার ইউক্রেনের দুই সেনা নিহত ও চারজন আহত হয়েছেন।কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল–জাজিরা বলছে, তাদের প্রতিনিধি মারিনকা শহরে গোলাগুলির শব্দ শুনেছেন।

গোলাবর্ষণের মধ্যে মারিনকা ছেড়ে শনিবার মারিওপুল পালিয়ে গেছেন ৪৬ বছর বয়সী ব্লিনোভা তেতিয়ানা আনাতোলিভনা। তিনি বলেন, ‘দোনেৎস্কে আমার আত্মীয় রয়েছে। তাঁরাসহ আমরা সবাই শান্তি চাই।’ এখন ওই এলাকায় যাঁরা রয়েছেন তাঁদের অধিকাংশই বয়স্ক। কেউ কেউ অসুস্থ। কারও বাড়িঘর ছেড়ে যাওয়ার অর্থ নেই। সাহায্য সংস্থাগুলো সতর্ক করে বলছে, যুদ্ধের মুখোমুখি থাকা উভয় পক্ষের প্রায় ২৯ লাখ মানুষের ইতিমধ্যেই জরুরি মানবিক সহায়তার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় পশ্চিমাদের আশঙ্কা, ইউক্রেন বড় ধরনের যুদ্ধের কিনারায়। যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে এ বিষয়ে সতর্ক করে আসছে।রাশিয়ার পক্ষ থেকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে তাদের সীমানায় গোলাবর্ষণ ও রুশপন্থীদের গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

এর পর থেকে রুশপন্থী বিচ্ছন্নতাবাদীরা ইউক্রেন খালি করার ও পুরোপুরি যুদ্ধ প্রস্তুতির ঘোষণা দিয়েছে।যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের অজুহাত তৈরির জন্য নাটক সাজানো হয়েছে। তবে পশ্চিমা গণমাধ্যমে সতর্কতা সত্ত্বেও অনেক ইউক্রেনীয় রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে অটল রয়েছেন।

মানিকার মাঝামাঝি একটি ছোট বাংলোয় একা বাস করেন ভ্যালেন্তিনা গর্দেয়েভা। অসুস্থ হয়ে স্বামীর মৃত্যু এবং ছেলেমেয়েরা দূরে চলে যাওয়ার পরও তিনি একাই থাকেন। তবে ২০১৪ সালে লড়াই শুরুর পর তিনি পাশের গ্রামে বোনের বাসায় চলে যান। তিনি আবারও সে কথাই ভাবছিলেন। কিন্তু ঘর ছাড়তে তাঁর মন চাইছিল না। তিনি বলেন, ‘বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। কী ঘটবে আমরা জানি না। তবে ঘটতে পারে। আমি খুব ভয় পেয়েছি।’

এদিকে ভ্যালেন্তিনার বয়সী মারিনকা গ্রামের আরেক বাসিন্দা ওলেনা ইভানিভনা তিন নাতি-নাতনি নিয়ে বাংকারে আশ্রয় নিয়েছেন। গত শনিবার সকালে তাঁদের ঘরের ছাদ ধসে পড়েছে। গত সপ্তাহ থেকে তাঁদের বিদ্যুৎ সুবিধা নেই। পানির পাইপ নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ওলেন বলেন, ‘তাঁরা বোধ–বিবেচনা হারিয়ে ফেলেছেন। আমরা এখন বাড়ি ছাড়ছি না। তারা গুলি চালাচ্ছে আর আমরা লুকিয়ে পড়ছি। এভাবেই চলছে।’

ইউক্রেনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা বেসামরিক অবকাঠামোতে গুলি চালাবে না এবং আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের নিয়ম মেনে চলবে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তাঁর দেশ উসকানির জবাব দেবে না। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে দেশটির সরকারি সেনাদের রক্তক্ষয়ী সংঘাত মারাত্মকভাবে বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এমন কথা বলেন জেলেনস্কি।

তবে জেলেনস্কি বিশ্বনেতাদের বলেছেন, রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষা করবে ইউক্রেন। জার্মানির মিউনিখে একটি নিরাপত্তা সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনীয়রা আতঙ্কিত নয়। আমরা আমাদের মতো করে বাঁচতে চাই।’

ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, গত শনিবার রাশিয়ার সেনাদের ১২২টি নিয়ম ভঙের ঘটনা তারা রেকর্ড করেছে। এর মধ্যে মিনস্ক চুক্তি অনুসারে নিষিদ্ধ অস্ত্রের ব্যবহারের ঘটনা ১০৮টি। তাদের দুজন সেনা নিহত হয়েছে। রুশ সেনাদের গোলা আবাসিক ভবনের কাছাকাছি পড়ছে। এই উসকানিতে ইউক্রনের বাহিনী পাল্টা গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, তথ্যপ্রমাণ বলছে, রাশিয়া ১৯৪৫ সালের পর ইউরোপে সবচেয়ে বড় যুদ্ধের পরিকল্পনা করছে। বিবিসির সোফি রাওয়ার্থকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বরিস জনসন। তিনি জার্মানির মিউনিখ শহরে বসে এ সাক্ষাৎকার দেন।

সাক্ষাৎকারে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব লক্ষণ বলছে যে পরিকল্পনার (যুদ্ধের) বাস্তবায়ন ইতিমধ্যে এক অর্থে শুরু হয়ে গেছে। বরিস জনসন বলেন, গোয়েন্দা তথ্য বলছে, রাশিয়া এমনভাবে আগ্রাসন শুরু করতে চায়, যা ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভকে ঘিরে ফেলবে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধে যে শুধু জীবনেরই ক্ষয় হবে, তা মানুষকে বুঝতে হবে।

বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, পশ্চিমা শক্তিগুলো ইউক্রেনে আসন্ন আক্রমণ প্রতিরোধে রোববার আরেক দফা কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপ করেছেন। এ সময় ইউক্রেনে বড় সংঘাত এড়াতে শেষ সম্ভাব্য এবং প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা নিয়ে কথা বলেছেন তাঁরা। এদিকে বেলারুশের সঙ্গে রাশিয়ার যৌথ সামরিক মহড়া এখনই শেষ হচ্ছে না। রোববার তা শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এর মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলেছেন বেলারুশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী।

ইউক্রেনে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে অর্থায়নের পরিকল্পনা রয়েছে বিশ্বব্যাংকের। এর অংশ হিসেবে দেশটিকে ৩৫ কোটি মার্কিন ডলার দেবে সংস্থাটি। আগামী মার্চের মধ্যেই এ অর্থ ছাড়ের বিষয়টি বিবেচনা করবেন বিশ্বব্যাংকের নীতিনির্ধারকেরা। এক বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, স্থানীয় সময় গতকাল শনিবার জার্মানির মিউনিখ শহরে বৈঠক করেন সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। সেখানে মালপাস বলেন, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে ইউক্রেনের অর্থনীতি ও নাগরিকদের পাশে থাকবে বিশ্বব্যাংক।