বাড়ি অর্থ ও বাণিজ্য কেন স্বর্নের দর এভাবে বেড়েই চলছে, কোথায় থামবে এই দর

কেন স্বর্নের দর এভাবে বেড়েই চলছে, কোথায় থামবে এই দর

0
স্বর্নের দর নির্ধারণ কিভাবে হয়

অতিমহামারি কোভিড–১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ স্বর্নের দর বৃদ্ধির এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। অনিশ্চয়তাই অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। কিন্তু অনিশ্চয়তার সময়টাই আসলে সোনার স্বর্ণসময়। যত বেশি অনিশ্চয়তা, তত বেশি সোনা বিক্রি। যত বেশি মূল্যস্ফীতি, তত বেশি সোনার দাম বৃদ্ধি। ঐতিহাসিকভাবেও দেখা গেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়েই সোনার দাম সবচেয়ে বেশি বাড়ে।

সোনার ভরি এখন দেশে ৮৪ হাজার ৫৬৪ টাকা। সোনার দামে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন রেকর্ড। দাম বেড়েছে বিশ্বব্যাপীই। সবারই এখন একই প্রশ্ন—কেন সোনার দর এভাবে বেড়েই চলছে, কোথায় থামবে দর।সোনার দামের সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির একটি গভীর সম্পর্ক আছে। বিশ্ব অর্থনীতি এখন কেমন আছে, এর উত্তর একটাই—‘অনিশ্চয়তা’। আগামী দিনগুলোতেও এই অনিশ্চয়তা এবং ঝুঁকি থাকবে বলেই বিশেষজ্ঞরা বলছেন।

এমন নয় যে সোনার দাম কেবল লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছেই। মাঝেমধ্যে কমছেও। এটাও অনিশ্চয়তার ফল। সুদের হার বাড়ানো নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা বা অর্থনীতি মন্দায় আক্রান্ত হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার ওপরও নির্ভর করছে সোনার দরের ওঠানামা। এই দাম আপাতত কমবে, এমন পূর্বাভাসও কেউ দিচ্ছেন না। যখনই মনে হয় অর্থনীতির সংকট হয়তো কেটে যাচ্ছে, তখনই সোনার দাম খানিকটা পড়ে যায়। আবার যখন মনে হয় সুদহার বাড়িয়েও কাজ হচ্ছে না, তখনই দাম বাড়ে সোনার।

এখন বিশ্বব্যাপী ডলারেরও রমরমা অবস্থা। বিশ্বের বেশির ভাগ প্রধান মুদ্রা ডলারের বিপরীতে মূল্যমান হারিয়েছে। ফলে চাঙা ডলার অনেক দেশের জন্যই বিপদের কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের দেশগুলো আছে বেশি বিপদে। তাদের আমদানি বেশি, রপ্তানি কম। আর সিংহভাগ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য যেহেতু ডলারে করতে হয়, তাই এসব দেশকে টিকে থাকতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করতে হচ্ছে। ডলারের ওপর অতিনির্ভরশীলতা থেকে বাঁচতে রাশিয়া ও চীনসহ বিভিন্ন দেশ বহু আগে থেকেই সোচ্চার। ভবিষ্যতেও হয়তো এ নিয়ে নানা উদ্যোগ থাকবে। এতে ডলারের ওপরে আস্থা কমে গেলে অনেকেই সোনার দিকে ঝুঁকে পড়বে।

জ্বালানি তেলের কেনাবেচার সঙ্গেও সোনার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। সাধারণত দেখা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সোনার দামও বেড়ে যায়। কারণ, তখন অনেক দেশই সোনার বিনিময়ে জ্বালানি তেল বিক্রি করে থাকে। আর যেহেতু এখন ডলারের কারণে বিশ্বের মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা চলছে, ফলে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে সোনার চাহিদাও বাড়ছে।

সোনার চাহিদা তৈরি হয় দুভাবে। যেমন গয়নার চাহিদা এবং সোনায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি। গয়না হিসেবে সোনার বেশি প্রচলন চীন ও ভারতে। পশ্চিমা দেশগুলোয়ও গয়নার ভালো চাহিদা আছে। আন্তর্জাতিক গোল্ড কাউন্সিলের হিসাবে, সরবরাহকৃত মোট সোনার ৪৭ শতাংশই ব্যবহার করা হয় গয়নায়, এর পরিমাণ ২ হাজার ২৩০ টন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারতে এখনো সোনা বিক্রির মৌসুম শুরু হয়নি। সাধারণত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বড় কোনো উৎসব থাকে না। এটি বিয়ের মৌসুমও নয়। এই মৌসুম শুরু হবে নভেম্বর থেকে। সে সময়েই সোনার চাহিদা অনেক বেড়ে যাবে।

এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে সোনায় বিনিয়োগ করার জন্য বন্ডসহ নানা ধরনের আর্থিক সম্পদ আছে। অনিশ্চয়তার সময় এই খাতে বিনিয়োগ বাড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও ভবিষ্যতের জন্য সোনার মজুত বাড়িয়ে দেয়। হিসাব অনুযায়ী, সোনার বার ও সোনার মুদ্রায় বিনিয়োগের পরিমাণ ১ হাজার টন। মোট সরবরাহের ২১ শতাংশই বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে সোনার ব্যবহার হয়ে থাকে।

গোল্ড কাউন্সিল বলছে, গত জুলাই মাসে বিশ্বের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৩৭ টন সোনা কিনেছে। এর মধ্যে কাতার একাই কিনেছে ১৫ টন। এর মাধ্যমে তারা ৭২ টন সোনার মজুত গড়ে তুলল। অর্থনৈতিক অবরোধ ও অনিশ্চয়তা থেকে বাঁচতেই কাতারের এই উদ্যোগ। এর বাইরে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিনেছে ১৩ টন, তুরস্ক ১২ টন এবং উজবেকিস্তান ৯ টন।

বিশ্বে সোনাকেই সবচেয়ে স্থিতিশীল ও নির্ভরযোগ্য পণ্য হিসেবে ধরা হয়। বলা হয়, একমাত্র সোনার দরেই সাধারণত বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা দেখা যায় না। সোনা কিনে রাখলে লোকসানের ভয় নেই বলা যায়। এ কারণেই সোনার প্রতি সবার এত আকর্ষণ। ৫০ বছর আগে কেউ সোনা কিনে রাখলেও তা ভালো বিনিয়োগ হিসেবেই বিবেচিত। শেয়ারবাজার, ডলার বা অন্য কিছু—এই নিশ্চয়তা দেয় না।

এমন নয় যে সোনার বাজারের সাময়িক ওঠানামা থাকে না। তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। গবেষক আ সা ও কারনী তাঁর স্বর্ণ বইতে এ ধরনের কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন ১৮১৫ সালে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ফ্রান্সে সেনাবাহিনী গঠন করলে লন্ডনের সোনার বাজারে এর দাম রাতারাতি এক পাউন্ডেরও বেশি বেড়ে গিয়েছিল।

পরে ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়ন পরাজিত হলেও সোনার দাম আবার কমে যায়। আবার ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে এবং এর কয়েক সপ্তাহ পরেই তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপ করে। এতে এক বছরের মধ্যে লন্ডনের বাজারে সোনার দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়।

তবে এ ধরনের ঘটনা খুবই কম। বরং দীর্ঘ মায়াদে সোনাকেই সবচেয়ে স্থিতিশীল পণ্য বলে ধরে নেওয়া হয়। যেমন ১৯৭১ সালে ১ আউন্স সোনার বিনিময়ে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল পাওয়া যেত, ১৯৯১ সালেও একই পরিমাণ তেল পাওয়া গেছে। আবার ১৯০০ সালে একজন ব্রিটিশ শ্রমিক ৩০ ঘণ্টা কাজের বিনিময়ে যে সোনা আয় করতে পারতেন, ১৯৯২ সালেও তা প্রায় একই আছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মুদ্রার চাহিদা বেড়ে গেলেও সোনার মজুত বাড়েনি। এ পরিস্থিতিতে অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশ আইন পরিবর্তন করে সোনায় রূপান্তরযোগ্য অন্যান্য দেশের মুদ্রাও রিজার্ভ আকারে রাখার অনুমোদন দেয়। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বাড়াতে থাকলে অনেক দেশ পর্যাপ্ত সোনা জমা না রেখেই নোট ছাপাতে শুরু করে। আর এতেই সমস্যার উদ্ভব হয়। ১৯২৯ সালের পর বিশ্বমন্দা দেখা দিলে এ ব্যবস্থা পরিত্যক্ত হয়ে যায়। অনেক পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রেটন উড ব্যবস্থায় আইএমএফ পার ভ্যালু ব্যবস্থা চালু করলে আর্থিক ব্যবস্থায় সোনার গুরুত্ব অনেকটাই কমে যায়।

আর্থিক ব্যবস্থায় সোনার গুরুত্ব কমলেও সোনার স্বর্ণযুগ কিন্তু রয়েই গেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এখনো বিভিন্ন দেশের রিজার্ভের হিসাব তৈরির সময় সোনা মজুতের হিসাবটি বিবেচনায় রাখে। আবার অনিশ্চয়তার সময় সোনার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায় বলেই আলোচনায় বারবারই চলে আসে এই হলুদ দামি ধাতুটি।

বাংলাদেশের সোনার চাহিদা কত, এ নিয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই। স্বর্ণ নীতিমালায় বলা আছে, দেশে প্রতিবছর ২০ থেকে ৪০ মেট্রিক টন সোনার চাহিদা তৈরি হচ্ছে।আবার বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি বলছে, প্রতিবছর সোনা চোরাচালানের আর্থিক পরিমাণ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। মূলত সোনা চোরাচালানের অর্থ লেনদেন হয় হুন্ডিতে।

আবার গয়না বানানো ছাড়া দেশের সোনার তেমন কোনো চাহিদাও নেই। অন্যান্য দেশের মতো সোনায় বিনিয়োগ করার মতো কোনো বন্ড বা আর্থিক উপাদানও গড়ে ওঠেনি। ফলে গয়না বানানো বা সোনার বার কিনে রাখাই এখন একমাত্র বিনিয়োগ। অথচ সোনায় বিনিময়যোগ্য আর্থিক কোনো উপাদান থাকলে তাতে দেশই লাভবান হতে পারত, যা পাশের দেশ ভারতেও রয়েছে।

দেশের বাজারে এখন সোনার মূল্যবৃদ্ধি নিয়মিত ঘটনা হয়ে গেছে। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) সর্বশেষ সোনার দাম বাড়িয়েছে গত রোববার। ফলে এখন হলমার্ক করা ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম দাঁড়িয়েছে ৮৪ হাজার ৫৬৪ টাকা। এ ছাড়া হলমার্ক করা ২১ ক্যারেট সোনার ভরি ৮০ হাজার ৭১৫ টাকা, ১৮ ক্যারেট ৬৯ হাজার ১৬৮ টাকা ও সনাতন পদ্ধতির সোনার ভরির দাম ঠিক করা হয়েছে ৫৭ হাজার ৩৮৭ টাকায়।

বাংলা ম্যাগাজিন /এমএ