বাড়ি রাজনীতি আওয়ামী লীগ গত দুই সপ্তায় রাজনৈতিক দৃশ্যপটে বড় ধরনের পরিবর্তন

গত দুই সপ্তায় রাজনৈতিক দৃশ্যপটে বড় ধরনের পরিবর্তন

0
গত দুই সপ্তায় রাজনৈতিক দৃশ্যপটে বড় ধরনের পরিবর্তন

চেনা ছকেই চলছিল রাজনীতি। জাতীয় প্রেস ক্লাব, ডিআরইউ কিংবা অন্য কোনো মিলনায়তন। আলোচনা সভা, সেমিনার। কখনো কখনো প্রেস ক্লাবের সামনে রাস্তা আটকিয়ে সমাবেশ। সরকারের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি। বাধার মুখে পড়তে হয়েছে কমই। পশ্চিমা কূটনীতিকদের ভাষায় বিরোধীদের ‘স্পেস’ দেয়া  হচ্ছিল। কেউ কেউ প্রশংসা করছিলেন সরকারেরও।

গত ৩১শে জুলাই ভোলায় পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষে ছাত্রদল নেতাসহ দুই জন নিহত হন। তবে ২২শে আগস্ট থেকে পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্নরূপ নেয়। জ্বালানি তেল এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদসহ কয়েকটি দাবিতে এ দিন থেকে তৃণমূল পর্যায়ে বিক্ষোভ শুরু করে বিএনপি। এসব সমাবেশে জনসমাগম বাড়তে থাকে।

গেল দুই সপ্তায় দৃশ্যপটে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। যদিও পরিবর্তনের শুরুটা হয় গত ১১ই আগস্ট। সেদিন নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে বড় ধরনের শোডাউন করে বিএনপি।গেল কয়েক বছরে বিএনপি’র সবচেয়ে বড় সমাবেশ। আর এটিই দেখা দেয়, টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে।

এমনিতে আগামী নির্বাচন ঘিরে বিএনপি’র কৌশল আসলে কী তা নিয়ে রাজনীতিতে একধরনের ধোঁয়াশা রয়েছে। পর্দার আড়ালে আলোচনায় রয়েছে নানা তত্ত্ব ও গুজব। কিন্তু রাজপথে দলটির শক্তি প্রদর্শনের পরই দেখা যায় হার্ডলাইনের নীতি।

বিএনপি’র সমাবেশের এক সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকার রাজপথে বড় ধরনের শোডাউন করে সরকারি দল। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার মুখে উচ্চারিত হয় সেই স্লোগান, ‘খেলা হবে।’ আলোচিত নেতা, শামীম ওসমান তো খেলার ডেটই চেয়ে বসেন। একই ধরনের কথা শোনা যায় বিএনপি নেতাদের মুখেও।

সহসাই দেশের বিভিন্নস্থানে বাধার মুখে পড়ে বিএনপি। আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা বাধা দেয় এসব কর্মসূচিতে। চালানো হয় হামলা। ডাকা হয় পাল্টা সমাবেশ। একাধিকস্থানে হয় সংঘর্ষ। কোথাও কোথাও বড় ধরনের সংঘর্ষও হয়। শুরুতে নীরব থাকলেও একপর্যায়ে অ্যাকশনে নামে পুলিশ। হামলা-সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছে এ ধরনের খবর।

কেন হঠাৎ করে অ্যাকশনে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। কেনইবা কঠোর অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গ্রীন সিগন্যাল পেয়েই এ ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিশেষত বিরোধীদের কর্মসূচিতে জনসমাগম বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি ভিন্ন মোড় নিতে পারে- এমন আলোচনা রয়েছে।

আপাতত কৌশল হচ্ছে, বিরোধী শক্তিকে রাজপথে বড় ধরনের লোকসমাগম করতে না দেয়া। বিএনপি এবং বিরোধী দলগুলোর সক্রিয় নেতাকর্মী কারা তা নিয়ে নতুন করে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। করা হচ্ছে তালিকা। পুরনো মামলাগুলোও এসেছে আলোচনায়। ২০১৩-১৪ সালে আন্দোলনের সময় দায়ের হওয়া মামলার আসামিদের বর্তমান অবস্থান কী সে ব্যাপারেও খোঁজ নেয়া হচ্ছে।

বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন গত পহেলা সেপ্টেম্বর সবচেয়ে বড় সংঘর্ষটি হয়েছে নারায়ণগঞ্জে। সেখানে গুলিতে এক যুবদল কর্মী নিহত হয়েছেন। সর্বশেষ রোববার বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়েছে বরগুনায়। সেখানে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের হামলায় আহত হয়েছেন বিএনপিদলীয় সাবেক এমপি নুরুল ইসলাম মনি। নতুন করে হচ্ছে মামলা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেছেন, এ দফায় ২০ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতারা অবশ্য বলছেন- সন্ত্রাস ঠেকাতেই পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ বলেন, ‘‘আপনারা কি ২০১৩-১৪ সালের কথা ভুলে গেছেন? সে সময় বিএনপি-জামায়াত কীভাবে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করেছে। এ ধরনের চেষ্টা করা হলে একটি নির্বাচিত সরকার তো বসে থাকতে পারে না।’’

নতুন তৈরি হওয়া পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছে বিএনপি’র হাইকমান্ডও। দলটি যেকোনো মূল্যে রাজপথে থাকতে চায়। দলটি মনে করে নেতাকর্মীদের বাইরেও সাধারণ মানুষ এবারের কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে। তবে সরকারি দল এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অ্যাকশনের কারণে দুশ্চিন্তাও তৈরি হয়েছে বিএনপি’র মধ্যে। বিশেষ করে নতুন করে গ্রেপ্তার অভিযান তীব্র হয় কিনা তা নিয়ে রয়েছে নানা শঙ্কা।

পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন) হায়দার আলী খান বলেন, ‘‘ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। মানুষের জান ও মালের ক্ষতি করছে। পুলিশের কাজে বাধাসহ হামলা করছে। এতে পুলিশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অ্যাকশনে যেতে বাধ্য হচ্ছে।’’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে সংঘাত আরও বাড়তে পারে। বিশেষ করে নির্বাচন প্রশ্নে যখন রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো পথ দেখা যাচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে দু’দলের জেদাজেদি ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক মহড়ার ফল হলো সহিংসতা- যা সামনে আরও বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, বিরোধী দলগুলো অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম করছে। মানুষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ তৈরি করা, গণসংযোগ করার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সভা-সমাবেশ। এই সুযোগটা তাদের দেয়া উচিত।

বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘‘সারা দেশের বিভিন্ন কর্মসূচিগুলোতে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিচ্ছেন। এ ছাড়া আমরা যে ইস্যুতে কর্মসূচিগুলো পালন করছি সেখানে সাধারণ জনগণও অংশ নিচ্ছে। এখানেই সরকারের ভয়। এই ভয় থেকেই সরকারদলীয় লোকেরা বিএনপি’র নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে।

বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, একটা ফ্যাসিস্ট সরকার সব সময় নিপীড়ন করেই শাসন করে। এরই ধারাবাহিকতায় এই সরকার আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলা করছে। তিনি বলেন, সরকারের এই হামলা-মামলা আর মানবো না। আমরা এই ফ্যাসিস্ট সরকার এবং পুলিশকে মোকাবিলা করবো। কারণ আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমাদের আর পেছানোর জায়গা নেই।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরী বলেন, জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখন আকাশচুম্বী। দেশে এখন হাহাকার চলছে। সবকিছুর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে সারা দেশে কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি।

এতে মানুষ সাড়া দিচ্ছে। কারণ মানুষ এসব থেকে প্রতিকার চায়। এ জন্য তারা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু আমাদের সাধারণ কোনো মিছিলও সরকার বরদাশত করতে পারছে না। সবখানেই হামলা চালাচ্ছে। আবার উল্টো বিএনপি’র নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেই মামলা দেয়া হচ্ছে। এটা সত্যিকার অর্থে সরকারের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।

বাংলা ম্যাগাজিন /এসকে