বাড়ি অপরাধ ফরিদপুরে মুরগী বাবরের যত কারবার

ফরিদপুরে মুরগী বাবরের যত কারবার

3
ফরিদপুরে মুরগী বাবরের যত কারবার

সাবেক মন্ত্রী ও ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের সাংসদ খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরকে (৬৭) মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল সোমবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে বসুন্ধরা এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ জলিল ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

এলাকার লোকজনের ভাষ্য, ওই সময় খন্দকার মোহতেশাম হোসেনের মূল ব্যবসা ছিল মুরগি লালন–পালন করা ও ডিম বিক্রি করা। এ জন্য তিনি ফরিদপুরে ‘মুরগি বাবর’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি একটি মোটরসাইকেলে করে তখন চলাফেরা করতেন।

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পাসপোর্ট অফিস, সড়ক বিভাগ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, বিদ্যুৎ বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের টেন্ডার বাবরের নির্দেশ ছাড়া কেউ পেতেন না। তিনি ফরিদপুরে মিস্টার ১৫ শতাংশ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কোনো কাজ করতে গেলে তাঁকে ১৫ শতাংশ টাকা দিতে হতো।

ফরিদপুরের রাজনীতির অঙ্গনে খন্দকার মোহতেশাম হোসেন (বাবর) পরিচিত কোনো নাম ছিলেন না একসময়। ভাইয়ের ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে তাঁর ক্ষমতা। একসময় তিনি ফরিদপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। ২০০৮ সালে তাঁর ভাই খন্দকার মোশাররফ হোসেন এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলে তিনি ভাইয়ের পক্ষে কাজ করেন।

ফরিদপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শামসুল হক ওরফে ভোলা মাস্টার বলেন, ‘বাবর বিএনপি ঘরানার রাজনীতি করতেন। খন্দকার মোশাররফ টাকাপয়সা কামাইয়ের জন্য বাবরকে দলে টেনে আনেন।

বাবর যেহেতু বিএনপির রাজনীতি করতেন, সেহেতু ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রভাব-প্রতিপত্তির ক্ষেত্রে বিএনপির লোকদেরই প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁদের সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন, বিনিময়ে নিজের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিদের প্রতি মামলা-হামলা করে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছেন। এ কারণে দল হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ।’

নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথমে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী হন। পরে তিনি শ্রমমন্ত্রী হন। ২০০৯ সালের মাঝামাঝি থেকে ফরিদপুরে ভাইয়ের ছায়া হিসেবে আবির্ভূত হন খন্দকার মোহতেশাম হোসেন। তিনি খন্দকার মোশাররফের অলিখিত প্রতিনিধি হিসেবে ফরিদপুরের যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করেন এবং আওয়ামী লীগে তাঁর প্রভাব বিস্তার শুরু করেন।

আওয়ামী লীগ নেতা শামসুল হক আরও বলেন, টেন্ডার–বাণিজ্যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন বাবর।‌ তিনি ধারণা করেন, যত দিন বাবরের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল; সরকারি অফিসে যে পরিমাণ টেন্ডারবাজি হয়েছে, তাতে হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন মোহতেশাম। তিনি বলেন, ‘আমি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলাম। পরেরবার তিনি ওই পদে নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হয়েই তিনি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এমন অনেক প্রকল্প সৃষ্টি করেছেন, যার কাজ না করে তিনি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।’

মোহতেশামের গ্রেপ্তারের বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন বলেন, এ ঘটনা প্রমাণ করে যত বড় ব্যক্তি কিংবা যত গুরুত্বপূর্ণ নেতাই হোন না কেন, দুর্নীতি করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। মোহতেশামের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তার সঠিক তদন্ত করে বিচারের ব্যবস্থা নেওয়া হলে দেশে আইনের শাসনের একটি উদাহরণ সৃষ্টি হবে বলে তিনি মনে করেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন খন্দকার মোহতেশাম হোসেন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সুবল চন্দ্র সাহা। রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী শেখ মাহাতাব আলীর কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়ে তাঁকে সমর্থন দিয়ে দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত করতে সার্বিক ভূমিকা পালন করেছেন বাবর। ২০১৪ সালে তিনি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ রয়েছে।

ওই নির্বাচনে বিএনপি–সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন যুবদল নেতা মাহাবুবুল হাসান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, তাঁর বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের প্রভাব খাটিয়ে তাঁর ভাইকে জয়ী দেখানো হয়েছিল।উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন মোহতেশাম।

২০১৬ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার জন্য বহু দেনদরবার করে ব্যর্থ হন বলে ফরিদপুরের রাজনৈতিক মহলে আলোচনা আছে। পরে অবশ্য তাঁকে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি করা হয়।

২০২০ সালের ১৬ মে ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবলচন্দ্র সাহার বাড়িতে একটি হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ১৮ মে মামলা করেন সুবল সাহা। এ মামলার সূত্র ধরে ওই বছরের ৭ জুন রাতে পুলিশের বিশেষ অভিযানে খন্দকার মোশাররফের প্রিয় দুই শিষ্য আলোচিত দুই ভাই বরকত-রুবেল গ্রেপ্তার হন। এরপর রাজনীতি থেকে নির্বাসিত হন খন্দকার মোশাররফ হোসেন।

ফরিদপুরের আলোচিত দুই ভাই শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও তাঁর ভাই ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি ইমতিয়াজ হাসানের নামে দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ এনে ২০২০ সালের ২৬ জুন ঢাকার কাফরুল থানায় মামলাটি করেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক এস এম মিরাজ আল মাহমুদ।

অভিযোগ আছে, সৈয়দ মাসুদ হোসেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলে ২০১৬ সালে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে ফুল দেন। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক বদিউজ্জামান। ফেরার পথে হামলার শিকার হন বদিউজ্জামান। তাঁকে কুপিয়ে জখম করা হয়। এ ছাড়া আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা শওকত আলী জাহিদ ও জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মনির হোসেনের ওপর তাঁর নির্দেশে হামলার অভিযোগ আছে।

এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘বাবরের নির্দেশে তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সন্ত্রাসী হত্যা করার জন্য আমার ওপর হামলা চালায়। আমাকে জখম করে। সৌভাগ্যবশত বেঁচে যাই।’ মোহতেশামদের পরিবারকে ‘রাজাকার পরিবার’ হিসেবে উল্লেখ করে‌ তিনি বক্তৃতা দিতেন বলে তাঁর ওপর হামলা হয়েছিল বলে তাঁর অভিযোগ।

হামলার ঘটনায় তাঁর করা মামলায় পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। তিনি আরও বলেন, ২০২০ সালে মোশাররফ রাজনীতি থেকে অপসারিত হলে তিনি মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। তবে সে ব্যাপারে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

গত ২০২১ সালের ৩ মার্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ কমিশনার (এএসপি) উত্তম কুমার সাহা ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এ মামলার এজাহারভুক্ত আসামি খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর।

ভাইয়ের গ্রেপ্তার ও নানা দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে ফরিদপুর-৩ আসনের সাংসদ খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বাবর একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। তিনি ব্যবসা করতেন, রাজনীতি করতেন। ব্যবসা করলে উন্নতি হবে, এটি সহজ কথা। এমপি-মন্ত্রীদের ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন ব্যবসা করবে, এতে দোষের কিছু নেই। সে জন্য বলা যায়, এটা তাঁর (বাবর) নিজস্ব ব্যাপার। এ নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করা আমার জন্য বিব্রতকর।’