বাড়ি অপরাধ হ্যাকাররা দিনের পর দিন ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নিতে থাকে

হ্যাকাররা দিনের পর দিন ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নিতে থাকে

1
হ্যাকাররা দিনের পর দিন ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নিতে থাকে

অভিজাত পরিবারের সন্তান। দেখতে সুন্দরী। বয়স আঠারোর ঘরে। ব্যবহার করেন দামি হ্যান্ডসেট। দুই বছর হলো ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। ফেসবুকে ঘন ঘন আপলোড করেন নানা ভঙ্গির ছবি। বন্ধুরা তাতে লাইক-কমেন্ট করেন। ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারেই সমবয়সী বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে চ্যাট করেন।অডিও কলে কথাও বলেন। 

একদিন ঘনিষ্ঠ এক বান্ধবীর কাছ থেকে একটি লিংক আসে ম্যাসেঞ্জারে। সঙ্গে সঙ্গে লিংকে ক্লিক করেন। পরে ওই লিংক থেকে চাওয়া হয় ফেসবুক আইডি ও পাসওয়ার্ড। ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর কাছ থেকে লিংক এসেছে তাই আগ্রহ সহকারে পাসওয়ার্ড ও আইডি দেন। তার কিছুক্ষণ পর থেকে তার আইডিতে সমস্যার সৃষ্টি হয়। নিজের আইডিতে নিজেই ঢুকতে পারছিলেন না। কয়েক ঘণ্টা পরে অবশ্য আইডিতে ঢুকতে পারেন।

ততক্ষণে তার ম্যাসেঞ্জারে অপরিচিত কেউ নক করে। কথা বলার এক পর্যায়ে অপরিচিত ব্যক্তি জানায়, তার কাছে ওই তরুণীর বেশকিছু ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও আছে। তার কথামতো না চললে এগুলো ভাইরাল করে দিবে। আকুতি-মিনতি করে রেহাই পাননি তরুণী। পরে হ্যাকারদের চাহিদামতো টাকা দেন তরুণী। এভাবে দিনের পর দিন ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নিতে থাকে হ্যাকাররা। উপায়ন্তর না পেয়ে তরুণী তার পরিবারকে সবকিছু খুলে বলে। পরে থানায় মামলা দায়ের করা হয়।

এক তরুণীর দেয়া অভিযোগের তদন্ত করতে ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ চাঞ্চল্যকর বেশকিছু তথ্য পেয়েছে। সাইবার টিম জানতে পেরেছে তিন এলাকার তরুণ ও যুবকেরা আইডি হ্যাক করাকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। গত দেড় বছরে ওই এলাকা থেকে প্রায় ২০০ জন হ্যাকারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 

শুধু ওই তরুণী নন, সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুক আইডি হ্যাক করে ব্ল্যাকমেইল ভয়াবহভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে তরুণী ও যুবতীদের আইডি হ্যাক করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে হ্যাকাররা। আইডি হ্যাক করে তরুণীদেরকে ব্ল্যাকমেইল করে যে শুধু টাকা আদায় করছে সেটি নয়। বরং তাদেরকে ঠেলে দিচ্ছে নানা কিসিমের বিপদের দিকে।

ব্ল্যাকমেইলের শিকার অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। অনেক পরিবার অশান্তিতে ভুগছে। আবার কেউ কেউ প্রতারকদের চাহিদামতো টাকা ও অনেকক্ষেত্রে একান্ত সময় কাটাতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। কারণ আইডি হ্যাক করে হ্যাকাররা ওই আইডি’র ম্যাসেঞ্জার ঘাঁটাঘাঁটি করে ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও নিজের হেফাজতে নিয়ে যাচ্ছে। পরে এসব ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছে। 

মাদারীপুরের রাজৈর ও শিবচর এবং ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকার এসব হ্যাকাররা কয়েক বছরে লাখ লাখ আইডি হ্যাক করেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই তারা হ্যাকিং শুরু করে। সম্প্রতি সাইবার টিম মাদারীপুরের শিবচর থেকে ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে। তারা হলো- ওবায়দুর রহমান নোবেল (২০), শামীম সরদার (২১) ও সজীব খলিফা (২১)। এই তিন হ্যাকার প্রায় ২ হাজার তরুণীর আইডি হ্যাক করেছে। তাদের টার্গেটই থাকে তরুণী/যুবতীদের আইডি হ্যাক করে ব্ল্যাকমেইল করা।

এই তিন হ্যাকার বেশিদূর পর্যন্ত লেখাপড়া করেনি। ভালো কোনো ডিগ্রি বা প্রশিক্ষণও তাদের নেই। শুধুমাত্র ইউটিউবে আইডি হ্যাক করার ভিডিও দেখে তারা কৌশল রপ্ত করে। তারপর ১/২টা করে আইডি হ্যাক করে করে তারা এতটাই দক্ষ হয়েছে এখন চ্যালেঞ্জ করে যে কারো আইডি হ্যাক করতে পারে। প্রথমদিকে তারা নারী-পুরুষ উভয়ের আইডি হ্যাক করলেও কিছুদিন ধরে তারা শুধু তরুণী ও যুবতীদের আইডি হ্যাক করছিল।

সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইমসূত্র জানিয়েছে, গ্রেপ্তার তিনজন মিলেই একটি চক্র গড়ে তুলেছিল। চক্রের মূলহোতা ছিল ওবায়দুর রহমান নোবেল। এসএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করে নোবেল নারীদের পার্সের একটি দোকান দেয়। তার দোকানে নিয়মিত তরুণী-যুবতীদের আনাগোনা ছিল। যাদের অনেককে সে চিনতো। তখন থেকেই তাদের আইডি হ্যাক করার পরিকল্পনা করে। আরেক হ্যাকার শামীম সরদার চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে কাজ শুরু করে। আর সজীব খলিফা তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। পেশায় সে একজন দর্জি।

এই চক্রটি ইউটিউব দেখে এমনভাবে ফিশিং লিংক তৈরি করতো যেটি দেখে যে কারো ওই লিংকে ক্লিক করতে ইচ্ছা হবে। এছাড়া তারা যার আইডি হ্যাক করার টার্গেট করে প্রথমে তার কোনো ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির আইডি হ্যাক করে। পরে ওই আইডি থেকে ওই ফিশিং লিংক পাঠিয়ে দেয়।

যাতে করে টার্গেটকৃত তরুণী ওই লিংকে ক্লিক করে। লিংকগুলো সাধারণত কোনো কনটেস্টে আমন্ত্রণের মতো দেখায়। কেউ যখন এসব লিংকে ক্লিক করে, তখন একটি পপ-আপ আসে এবং ব্যবহারকারীকে আবার লগইন করতে বলে। ব্যবহারকারী লগইন করা মাত্রই আইডি’র নিয়ন্ত্রণ হ্যাকারদের কাছে চলে যায়।

ভুক্তভোগী এক তরুণী বলেন, তিন মাস আগে প্রবাসী এক ছেলের সঙ্গে মোবাইলে বিয়ে হয়েছে আমার। দেশে এলে আনুষ্ঠানিকতা হবে। আমার স্বামীর চাহিদা অনুযায়ী আমি আমার কিছু ব্যক্তিগত ছবি তাকে দেই। আমাদের ভিডিও কলে কথা বলার কিছু স্ক্রিনশট দু’জন শেয়ার করেছিলাম। তার কিছুদিন পর আমার ম্যাসেঞ্জারে অপরিচিত এক যুবক ওই ছবিগুলো পাঠায়। এসব দেখে আমার মাথা ঘুরতে থাকে। স্বামীর কাছে শেয়ার করা ছবি অপরিচিত যুবকের কাছে কীভাবে গেল। পরে সে আমাকে জানায়, আমার আইডি হ্যাক করেছে।

৫০ হাজার টাকা দিলে ছবি ও আইডি ফেরত দিবে। পরে আমি আমার স্বামীকে বিষয়টি জানাই। হ্যাকারের দেয়া কয়েকটি মোবাইল নম্বরে ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করলে আমার আইডি ও ছবি ফেরত দেয়। এই তরুণী আরও জানান, একই হ্যাকার আমার আইডিতে থাকা আরও কয়েকজন তরুণীর আইডি হ্যাক করে ব্ল্যাকমেইল করেছে।

সাইবারের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, তরুণীদের আইডি’র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হ্যাকররা প্রথমে তাদের ম্যাসেঞ্জারে প্রবেশ করে। তারপর ওই তরুণীরা যদি কারো সঙ্গে ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য কারো সঙ্গে শেয়ার করে সেগুলো তাদের হেফাজতে নিয়ে যায়। পরে অন্যকোনো আইডি দিয়ে হ্যাক করা আইডি’র মালিককে নক করে এসব তথ্য জানায়। প্রয়োজনে ওইসব ছবি-ভিডিও ম্যাসেঞ্জারে পাঠিয়ে সত্যতা নিশ্চিত করে। পরে তাদের চাহিদামতো টাকা বা অনেকসময় একান্ত সময় কাটানোর প্রস্তাব দেয়।

ডিবি’র সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ- পুলিশ কমিশনার জোনায়েদ আলম সরকার বলেন, তদন্ত করতে গিয়ে আমরা সত্যতা পেয়েছি এই তিন হ্যাকার দুই হাজার আইডি হ্যাক করেছে। তাদের টার্গেটই থাকে তরুণীদের আইডি হ্যাক করা। ফিশিং লিংক পাঠিয়ে আইডি হ্যাক করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর টাকা দাবি করে। টাকা নেয়ার পরও অনেকে আইডি ফেরত পায় না। তাদের ফাঁদে পড়ে অনেকে নিঃস্ব হয়ে যায়।

যাচাই- বাছাই না করে কোনো ধরনের ইউআরএল লিংকে ক্লিক করা থেকে বিরত থাকতে হবে ফেসবুক ইউজারদের। কোনো ইউআরএল লিংকে ক্লিক করার পর কোনো ফেসবুক পেজে বা অন্য কোথাও রিডাইরেক্ট হলে লগইনের জন্য ফেসবুক পাসওয়ার্ড আইডি দেয়া যাবে না। ফেসবুক আইডিতে টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশনের সঙ্গে একটি ই-মেইল আইডি যোগ করে দিতে হবে। নিয়মিত অথরাইজড লগইন অপশন চেক করতে হবে। এছাড়া ফেসবুক আইডি বা ম্যাসেঞ্জারে একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি বা ভিডিও রাখা যাবে না।

মোবাইলে আসা নোটিফিকেশনে ইয়েস বা নো ক্লিক করার আগে বিষয়টি ভালোভাবে পড়ে নিতে হবে। আর ফেসবুকে তিন থেকে পাঁচজন ট্রাস্টেড কনট্রাক্ট যোগ করে নিতে হবে। তাতেই ফেসবুক আইডি হ্যাকার থেকে সুরক্ষিত রাখা যাবে।