বাড়ি অপরাধ নারীর লাশের রহস্য ৬ বছর পর উদঘাটন

নারীর লাশের রহস্য ৬ বছর পর উদঘাটন

0
নারীর লাশের রহস্য ৬ বছর পর উদঘাটন 1

২০১৫ সালের ৩ মে। রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনালে চট্টগ্রাম থেকে আসা ঈগল পরিবহনের একটি বাসে ট্রাংকের ভেতরে এক অজ্ঞাতনামা নারীর লাশ পাওয়া যায়। পুলিশ, সিআইডির হাত ঘুরে লাশের পরিচয় শনাক্তে তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। ঘটনার ছয় বছর পর পিবিআই ওই লাশের পরিচয় শনাক্ত করে এবং এর সঙ্গে জড়িত এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে।

এ বিষয়ে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পিবিআই জানিয়েছে, ২০১৫ সালের ৩ মে সকাল ৯টার দিকে চট্টগ্রাম এ কে খান মোড়ে ঈগল পরিবহনের কাউন্টারে টিকেট কেটে এক ব্যক্তি বাসের বক্সে একটি ট্রাঙ্ক তুলে দেন। বাসের হেলপারকে বলেন, সামনের ভাটিয়ারি কাউন্টার থেকে টিকিটের যাত্রী উঠবে কিন্তু পরবর্তী কাউন্টারে বর্ণিত যাত্রী না ওঠায় বাসটি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করে এবং সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ গাবতলীতে পৌঁছায়। 

পিবিআইয়ের প্রধান কার্যালয়ে আজ শনিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রধান পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ছয় বছর আগে গাবতলী বাস টার্মিনালে পাওয়া লাশটি চট্টগ্রাম থেকে নিখোঁজ হওয়া শম্পা বেগমের (২৮)। তাঁর গ্রামের বাড়ি খুলনার দৌলতপুরে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গতকাল শুক্রবার কুমিল্লার ইপিজেড এলাকা থেকে রেজাউল করিমকে (৩৮) গ্রেপ্তার করে পিবিআই। গ্রেপ্তারের পর রেজাউল আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে শম্পা হত্যার দায় স্বীকার করেন। রেজাউলের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার ইপিজেড এলাকায়।

ঈগল পরিবহনের সেই বাসটি সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ গাবতলীতে পৌঁছায়। শেষ গন্তব্যে সব যাত্রী তাদের জিনিসপত্র নিয়ে নেমে যায়। এরপর হেলপার দেখেন, বাসের বক্সে একটি ট্রাঙ্ক মালিকবিহীন পড়ে আছে। তখন বাসের ড্রাইভার-হেলপার মিলে ট্রাঙ্কটি নামিয়ে দেখেন, সেটি খুব ভারী। তাদের সন্দেহ হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে দারুসসালাম থানায় খবর দিলে পুলিশ গিয়ে ট্রাঙ্কটি খুলে একজন অজ্ঞাতনামা তরুণীর লাশ পান।

এরপর লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়। লাশের পরিচিতি শনাক্ত না হওয়ায় পরে অজ্ঞাতপরিচয় লাশ হিসেবে সেটি দাফন করা হয়। কেউ বাদী না হওয়ায় থানা পুলিশের পক্ষে এসআই জাহানুর আলী বাদী হয়ে আসামি অজ্ঞাত উল্লেখ করে দারুস সালাম থানায় (মামলা নং-০৬ তারিখ ০৩/০৫/২০১৫ ইং, ধারা ৩০২/২০১/৩৪ পেনাল কোড) মামলা দায়ের করেন।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রেজাউল পুলিশকে বলেন, তিনি ওই সময় নৌবাহিনীর করপোরাল (এখন অবসরে) পদে কর্মরত ছিলেন। ২০১৩ সালে খুলনা তিতুমীর নৌঘাঁটিতে কর্মরত থাকাকালীন একটি হাসপাতালে শম্পার সঙ্গে পরিচয় হয়। এর সূত্র ধরেই তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়। রেজাউল চট্টগ্রামে বদলি হয়ে আসার পর শম্পাও সেখানে চলে আসেন। শম্পা কিছুদিন ফুফুর বাসা এবং একটি হোটেলে অবস্থান করেন। এরপর পাহাড়তলীতে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে রেজাউলের সঙ্গে বসবাস শুরু করেন।

তাঁরা ২০১৫ সালের মে মাস পর্যন্ত ওই বাসাতে বসবাস করেছেন। তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য দেখা দিলে ২০১৫ সালের ২ মে রাতে শম্পার গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করেন রেজাউল। ঘটনা ধামাচাপা দিতে ট্রাংকে ভরে ঢাকাগামী ঈগল পরিবহনের একটি বাসে তুলে দেন শম্পার লাশ। এরপর তিনি শম্পার বাবা ইলিয়াস শেখকে জানান, শম্পাকে খুলনার বাসে তুলে দেওয়া হয়েছে। শম্পা বাবার বাড়িতে না পৌঁছলে তাঁরা বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেন।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, মামলাটি রুজু হওয়ার পর থেকে শুরুতে প্রায় তিন মাস থানা পুলিশ তদন্ত করে। এরপর সিআইডি দীর্ঘ চার বছর তদন্ত করে কিন্তু লাশের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় এবং হত্যা রহস্য উন্মোচিত না হওয়ায় আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে সিআইডি। রিপোর্ট গ্রহণ না করে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে দেয়। পিবিআই ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদারের নির্দেশে পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে।

পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) ইউনিট ইনচার্জ মো. জাহাঙ্গীর আলমের তত্ত্বাবধানে তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ ইন্সপেক্টর আশরাফুজ্জামান ভিকটিমকে শনাক্ত করার জন্য প্রচলিত সব পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। তদন্ত কর্মকর্তাকে স্ব-শরীরে চট্টগ্রাম এবং ওই জেলা এলাকার সব থানায় ২০১৫ সালে এন্ট্রিকৃত নিখোঁজ জিডিসমূহ অনুসন্ধান করে তথ্য নিয়ে আসার জন্য পাঠান পিবিআই ডিআইজি। তদন্ত কর্মকর্তা এক সপ্তাহ পরিশ্রম করে ওই সময়ে কাছাকাছি প্রায় দশ/বারোটি নিখোঁজ জিডির তথ্য উদঘাটন করেন।

ওই জিডিগুলোর মধ্যে একটি চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানা এলাকা থেকে তরুণী নিখোঁজের (জিডি নং-৫৯৯, তারিখ ১০/০৬/২০১৫ ইং মূলে দেখা যায় শম্পা বেগম, পিতা ইলিয়াস শেখ, গ্রাম: দেওয়ানা উত্তরপাড়া, থানা: দৌলতপুর, খুলনা)। ভিকটিম শম্পা বেগমের ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নান ২০১৫ সালের ১০ জুন পাহাড়তলী থানায় জিডিটি করেন।

পিবিআই পাহাড়তলী থানার একটি জিডির সূত্রে জানতে পারেন, শম্পা বেগম ৩ মে থেকে নিখোঁজ। তদন্ত কর্মকর্তা নিশ্চিত হন দারুস সালাম থেকে উদ্ধার হওয়া লাশটি শম্পার। যে ট্রাংকে শম্পার লাশ পাওয়া গেছে, সেটি তাঁর বাবা ইলিয়াস শেখের।

ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, এটি একটি সূত্রবিহীন মামলা ছিল। শম্পাকে হত্যার পর লাশ প্রথমে ট্রাংকে রাখেন। সেই ট্রাংক রিকশায় করে চট্টগ্রাম এ কে খান মোড়ে ঈগল পরিবহনের কাউন্টারে নিয়ে আসেন। টিকিট কেটে বাসের বক্সে ট্রাংকটি তুলে দেন। চালকের সহকারীকে তিনি জানিয়েছিলেন, ভাটিয়ারী কাউন্টার থেকে টিকেটের যাত্রী উঠবে। কিন্তু পরবর্তী কাউন্টারে বর্ণিত যাত্রী না ওঠায় বাসটি ঢাকার উদ্দেশে রওনা করে।শম্পার বাবা ইলিয়াস শেখ বলেন, শম্পার সঙ্গে রেজাউলের বিয়ে হয়েছে বলেই তাঁরা জানেন।