বাড়ি অর্থ ও বাণিজ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারিশ অবজ্ঞা করে কর্মীদের প্রণোদনা বোনাস দিয়েছে ৪ ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারিশ অবজ্ঞা করে কর্মীদের প্রণোদনা বোনাস দিয়েছে ৪ ব্যাংক

1
বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারিশ অবজ্ঞা করে কর্মীদের প্রণোদনা বোনাস দিয়েছে ৪ ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারিশ অবজ্ঞা করে ও আর্থিক অবস্থা দুর্বল হওয়া স্বত্তেও কর্মীদের প্রণোদনা বোনাস দিয়েছে রাষ্ট্রয়াত্ত ব্যাংক। ২০ জুন একটি চিঠির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংককে এই প্রণোদনা দেওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য। এই অনুরোধের নেপথ্যে রয়েছে ব্যাংকগুলোর দুর্বল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও করপোরেট সুশাসনের অভাব।

তবে মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি) ২০২০ সালের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের ভিত্তিতে নির্ধারিত এই বোনাস বণ্টন থেকে ব্যাংকগুলোকে নিবৃত্ত করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি।  সোনালী ব্যাংক চারটি এবং অগ্রণী ব্যাংক তিনটি পূর্ণ বোনাস ও আরেকটি বোনাসের এক চতুর্থাংশ দিয়েছে তাদের কর্মীদের। রূপালী ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক উভয়ে তিনটি করে বোনাস দিয়েছে। 

প্রতিটি প্রণোদনা বোনাস এক মাসের মূল বেতনের সমান। ব্যাংকগুলো ঈদুল আজহার ছুটির আগে প্রণোদনা বণ্টন করেছে। আগেও বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল অবস্থায় থাকা সরকারি ব্যাংককে প্রণোদনা বোনাস দেওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বার্ষিক নিরীক্ষামূলক প্রতিবেদনগুলোতে বেশ কয়েকবার উল্লেখ করেছে, সরকারি ব্যাংকগুলোর প্রণোদনা বোনাস দেওয়া উচিত নয়। এই চারটি ব্যাংক প্রভিশনের (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) ঘাটতি অথবা মূলধনের সংকটে ভোগার কারণে জুনে বাংলাদেশ ব্যাংক এই সুপারিশটি করেছে।

উদাহরণস্বরূপ, সোনালী ব্যাংকের গত বছর ৩ হাজার ৬৪ কোটি টাকার মূলধনের ঘাটতি ছিল। তবে ব্যাংকটিতে গত বছর প্রভিশনের ঘাটতি ছিল না এবং তারা ৩৩৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছে . বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, মুনাফা করা স্বত্তেও ব্যাংকটি যেহেতু মূলধনের ঘাটতিতে ভুগেছে, তাদের প্রণোদনা বিতরণ করা উচিত হয়নি।

অগ্রণী ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংকের প্রভিশনিং ঘাটতি ছিল যথাক্রমে ১ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা ও ৮২২ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংক গত বছর ৫ হাজার ৫৪ কোটি টাকা লোকসান করেছে এবং ব্যাংকটির মূলধনের ঘাটতি ছিল ৫ হাজার ৪৭৫ টাকা।

২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারি ব্যাংকগুলোর কর্মীদের প্রণোদনা সংক্রান্ত একটি নীতিমালা তৈরি করে সেটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল। নীতিমালা অনুযায়ী কর্মীরা ব্যাংকের প্রকাশিত মোট মুনাফার পরিমাণের ভিত্তিতে প্রণোদনা বোনাস পেতে পারেন। সেখানে আরও বলা হয়েছে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ ও অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশনিং বজায় রেখে মুনাফা করতে পারলেই কেবল তার ভিত্তিতে প্রণোদনা বণ্টন করতে পারবে।

গত বছরে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের সমষ্টিগত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৪ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা, যা সমগ্র ব্যাংকিং খাতের শ্রেণিকৃত ঋণের ৩৯ শতাংশ। খেলাপি ঋণের ধরণ অনুযায়ী নিরাপত্তা সঞ্চিতির হার শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।

প্রভিশনিং ঘাটতিকে বিবেচনায় নিলে ২০১৯ সালে চারটি ব্যাংকের মোট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সে বছর ব্যাংকগুলো সমষ্টিগতভাবে ৪৩৭ কোটি টাকা প্রণোদনা হিসেবে বিতরণ করে। ২০২০ সালের পরিমাণটি তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো লাভ করার জন্য তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবে এবং এক্ষেত্রে কর্মীদের উজ্জীবিত রাখার জন্য এবং তারা যাতে তাদের কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে করতে পারে, সে জন্য প্রণোদনা বোনাসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

তবে যে ব্যাংকটি লোকসান করছে, সেটির কাছ থেকে প্রণোদনা প্রত্যাশিত নয়, জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাটি। এফআইডি এর সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুস সালাম আজাদ জানান, প্রণোদনা বোনাসের ঐতিহ্য হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলে কর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিবে।

‘প্রণোদনা কর্মীদের আরও ভালো কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করবে’, জানান তিনি। অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস্-উল ইসলাম জানান, অর্থ মন্ত্রণালয় বা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে ব্যাংক প্রণোদনা বিতরণ করত না।

‘আমাদের অনেক কর্মকর্তা মহামারির মধ্যে ধৈর্য্য সহকারে তাদের নিজ দায়িত্ব পালন করছেন এবং তাদেরকে সেজন্য পুরস্কৃত করা উচিত’, জানান তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য এটি ভালো লক্ষণ নয়, বিশেষ করে যখন তারা যখন অনেক বছর ধরে করপোরেট সুশাসনের অভাবে আছে ও অন্যান্য সমস্যার মোকাবিলা করছে।

তিনি জানান, ‘অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারিশ অনুযায়ী উদ্যোগ নেওয়া।’ ব্যাংকগুলো উৎসব বোনাস দিতে পারে, কিন্তু সরকারি ব্যাংকগুলোর দুর্বল ফলাফলের মধ্যে এ ধরনের প্রণোদনা প্রযোজ্য নয়, জানান সালেহ উদ্দিন। সরকারি মালিকানাধীন আরেকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক বারবার লোকসান করতে থাকায় ২০১৩ সাল থেকে প্রণোদনা বোনাস দেওয়া বন্ধ রেখেছে।

দুটি বিশেষায়িত ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে লোকসানের পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য একই কৌশল অবলম্বন করেছে। এছাড়াও বেশিরভাগ বেসরকারি ব্যাংকগুলো চলমান ব্যবসায়িক মন্দার কারণে ২০২০ এ কোনো প্রণোদনা দেয়নি, জানিয়েছেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।